মো. জিল্লুর রহমান

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

বই পড়ার আনন্দ ও অমর একুশের বইমেলা

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ, তা বই পড়ে মেটানো হয়। একটি ভালো বই-ই হচ্ছে মনের খোরাক জোগানোর অন্যতম উপায়। বই মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। একটি ভালো বই ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তোলে। জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে হলে, সুবাসিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হয়। আর জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের কথা যেন বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তাই জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে বই পড়তেই হবে। নিজেকে জানতে হলে, পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তেই হবে। বই হচ্ছে সমুদ্রের মতো, এক একটা বই হচ্ছে জ্ঞানের এক ফোঁটা সমুদ্রের জল। বই পড়া এমন এক তৃষ্ণা যা সহজে মেটে না, ভালো বই শুধু পড়তেই মন চায়।

সত্যিকারভাবে বই হচ্ছে সভ্যতার সূতিকাগার, স্বপ্নের কারিগর, জ্ঞানের আধার ও মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। একজন মানুষ যে পেশায় যত দক্ষই হোক না কেন, যতবড় পণ্ডিত বা জ্ঞানীই হোক না কেন, তার দক্ষতা ও পেশাদারিত্বে উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য তাকে বারবার বইয়ের কাছেই ফিরে আসতে হয়। কারণ জ্ঞানের সূচনা বই থেকে শুরু হয় এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা বই থেকেই পেয়ে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমেই শুরু হয়। এজন্য বইকে বলা জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম এবং জীবনকে আপন আলোয় আলোকিত করার প্রধান উপায়ই হচ্ছে বই। বই পড়েই জ্ঞানার্জন করতে হয়। পৃথিবীতে যারা যত বড় হয়েছেন, জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন, তারাই বেশি বেশি জ্ঞান অন্বেষণে বই পড়েছেন। পৃথিবীর যেকোনো বরেণ্য মনীষীদের জীবন ইতিহাস ঘাঁটলে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। দেশ ও জাতি গঠনে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে লেখক-পাঠক-শিশু-বৃদ্ধ সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ফেব্রুয়ারি মাস। কারণ পুরো ফেব্রুয়ারিই চলে সবার প্রাণপ্রিয় অমর একুশের বইমেলা। একুশের চেতনার পূর্ণাঙ্গ ফসল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে একুশের চেতনায় ধীরে ধীরে অমর একুশে বইমেলা একটি স্থায়ী রূপ পেয়েছে। অমর একুশে বইমেলার শুধু পরিসর বৃদ্ধিই পায়নি, বরং বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে এখন সেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি মাসব্যাপী স্থায়ী বইমেলায় পরিণত হয়েছে। মাঝখানে করোনা মহামারির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলা কিছুটা নানা ধরনের শৃঙ্খলার ঘেরাটোপে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। কিন্তু এরপর অমর একুশে বইমেলা আবারও স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হয়েছে।

আমাদের সব জাতি গোষ্ঠী, বর্ণ ও শ্রেণির সবার জন্যই এককথায় আমাদের একটাই সাংস্কৃতিক উৎসব। আর সেটা অবশ্যই ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলা অমর একুশে বইমেলা। যে কারণে দেশের সর্ববৃহৎ এই সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য প্রকাশক লেখক পাঠকরা বাকি এগারো মাস মুখিয়ে থাকেন। বইমেলার সবচেয়ে প্রাণবন্ত দৃশ্য হলো যেদিকেই দৃষ্টি যায়, সেদিকেই কেবল বই আর বই, যেন এক জ্ঞান সমুদ্র। এ কারণেই মাসব্যাপী এই বইয়ের হাট সবার সবচেয়ে প্রিয় মিলনমেলা। বইমেলায় গেলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় শিশুরা। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, নতুন বইয়ের সুন্দর সুন্দর প্রচ্ছদ, নতুন বইয়ের চোখ ধাঁধানো বাঁধাই, নতুন বইয়ের চমৎকার সব লেখা, তারা এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে প্রচুর আনন্দ পায়, প্রিয় বইটি কিনে নেয়। এমনকি বইমেলা থেকে অনেকে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা করারও খোরাক পায়। কেউ কেউ লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যে কারণে অমর একুশে বইমেলা সবারা প্রাণের মেলা।

আগে শুধু পত্রপত্রিকায় বইমেলা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু ইদানীং গণমাধ্যমের পাশাপাশি প্রতি বছরই আমরা অমর একুশে বইমেলার ভালো এবং মন্দ দিক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সরব থাকি। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য থাকে প্রাণের এই অমর একুশে বইমেলা যেন আরো সুন্দর হয়, আরো পরিপাটি হয়, আরো গোছানো হয়, আরো পরিচ্ছন্ন হয়, আরো নির্বিঘ্ন হয়, আরো স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বজনীন হয়, সেটি যেন আয়োজক বাংলা একাডেমি যথাযথভাবে পালন করে।

বইমেলায় গেলে সারা দেশ ও বিদেশ থেকে আগত লেখক-পাঠকদের একটি মিলনমেলা হয়, অনেক পাঠকপ্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে এবং অটোগ্রাফ নেওয়ার পর যেন তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। অনেকেই আগত বন্ধুদের সঙ্গে কুশলবিনিময় ও চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পায়। তারা শুধু অমর একুশে বইমেলার মাসেই এই সুযোগটি পায়। বইমেলায় গেলে নতুন বই নিয়ে শিশুদের অবারিত আনন্দ দেখার সুযোগ সত্যিই মনোমুগ্ধকর এবং এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দ। বই নিয়ে শিশুদের আনন্দময় চোখ দেখা যেকোনো লেখকের জন্য একটি অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য।

বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু ও বিনোদন আর কিছুই হতে পারে না। বই পড়া মানসিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে, মস্তিষ্কের চিন্তা করার খোরাক জোগায়, সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা সৃষ্টি করে। বই পড়লে মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক মনস্ক হয়ে ওঠে। সুস্থ বিনোদন মানুষের মানসিক বিকাশে নানাভাবে সহায়তা করে। পাঠাভ্যাস একটি নির্মল বিনোদনের উৎস। ভালো বই পড়া, জীবনশৈলী ভালো সিনেমা দেখা, বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের জীবনীগ্রন্থ পড়া, নিয়মিত খবরের কাগজ পড়া যেমন দক্ষতা ও মনের খোরাক বাড়ায়, তেমনি জ্ঞানচর্চা এবং সৃজনশীল কাজ মানসিক বিকাশে অন্যতম ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে কাছের বন্ধুও মানুষকে ছেড়ে যেতে পারে কিন্তু বই সেটা করে না। এজন্য বই হোক মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ও নিত্যসাথি, সুস্থ বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ও সভ্যতা বিকাশের চাবিকাঠি।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এবং এটি হচ্ছে একটি ঐশী গ্রন্থ, যার প্রথম নাজিলকৃত আয়াতের প্রথম শব্দ ইকরা বা পড়। অর্থাৎ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনও পড়া বা জ্ঞানার্জনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন প্রখ্যাত লেখক বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি, বই কেনার বাজেট যদি আপনি তিন গুণও বাড়িয়ে দেন, তবু তো আপনার দেউলে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ আসলেও তাই, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি কখনো, কিন্তু বই পড়ে জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, দেশ ও জাতি এবং মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পেরেছে, এমন মানুষের সংখ্যা অধিক। বইয়ের মতো আপন বন্ধু পৃথিবীতে আর কেউই নেই। আসুন সবাই বইমেলা থেকে বেশি বেশি কিনি, আর জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করি। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী, অমর একুশের বইমেলা হোক সর্বশ্রেষ্ঠ মেলা।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close