মুফতি আবদুর রহমান

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

শবেবরাত : তাৎপর্য, করণীয় ও বর্জনীয়

মুসলমানদের গোটা জীবনই বিভিন্ন ইবাদতের ফ্রেমে বাঁধানো। কেননা রুহ জগতে আল্লাহর ইবাদত করার অঙ্গীকার করেই মানুষ এ দুনিয়ায় এসেছে। তবু মানুষ দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে মোহগ্রস্ত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়, আল্লাহর পথ থেকে সরে যায়। আল্লাহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজ বান্দাদের কাছে টেনে নিতে চান।

তাদের জন্য নিজ অনুগ্রহ অবারিত করেন। পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পূতঃপবিত্র করতে তওবার দরজা উন্মুক্ত রাখেন। এ ছাড়া বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষকে নিজ প্রতিপালকের আরো কাছে আসার সুযোগ করে দেন। মূলত ইসলামে অশুভ বলে কিছু নেই। তথাপি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টিজগতে এক বস্তুর ওপর অন্য বস্তুকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। যেমন : স্থান হিসেবে মক্কা-মদিনা অন্যান্য স্থান থেকে শ্রেষ্ঠ। কূপের মধ্যে জমজম সর্বশ্রেষ্ঠ। সাপ্তাহিক দিনের মধ্যে জুমার দিন শ্রেষ্ঠ।

মাসের মধ্যে রমজান সর্বশ্রেষ্ঠ। রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদর শ্রেষ্ঠ। ঠিক তেমনি ‘শবেবরাত’ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাত। এসব মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। এ উপহারগুলো গ্রহণ করে ওই শ্রেষ্ঠ স্থান, দিন-রাত ও সময়কে মুমিনরা কাজে লাগিয়ে যত বেশি আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হয়, আল্লাহতায়ালা তত বেশি মুমিনের পার্থিব-অপার্থিব মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। তাই মুমিনদের উচিত এসব স্থান ও সময়ে যথাসাধ্য ইবাদত ও জিকির-আজকারে নিমগ্ন হয়ে আল্লাহর নৈকট্যলাভে ব্রত হওয়া।

শবেবরাতের নামকরণ : শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতই আমাদের কাছে ‘শবেবরাত’ হিসেবে পরিচিত, যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। ফারসি ‘শব’ আর আরবি ‘লাইলাতুন’ অর্থ রজনি, রাত। ‘বারাআত’ অর্থ হলো মুক্তি, পরিত্রাণ। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় ‘পরিত্রাণের রজনি’। যেহেতু হাদিস শরিফে বারবার বিবৃত হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ মুসলমানদের মাগফিরাত বা গুনাহ থেকে পরিত্রাণ দেন, তাই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘শবেবরাত’। হাদিসের পরিভাষায় এই রাতের নাম হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত।

হাদিস শরিফে শবেবরাতের ফজিলত : হজরত মুআজ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে মাখলুকের প্রতি (বিশেষ) দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহে ইবনে হিব্বান ১২/৪৮১ হা. ৫৬৬৫, ইবনে আসেম ফিসসুন্নাহ হা. ৫১২, তাবারানি [কাবির] ২০১০৯ হা. ২১৫, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ৮/৬৫, শুআবুল ইমান [বায়হাকি] ৯/২৪ হা. ৬২০৪, মুসনাদুশ শামিইন [তাবারানি] ১/১২৮ হা. ২০৩) হাদিসটি সহিহ। তাবরানি বলেছেন, ‘এর সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।’

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে মাখলুকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও খুনি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ ১১/২১৬ হা. ৬৬৪)। হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমার কি জানা আছে, এই রাত তথা মধ্য শাবানের রাতে কী হয়? হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, কী হয়, ইয়া রাসুলাল্লাহ? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এই বছর যারা জন্ম নেবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে, সব এই রাতে লেখা হয়। এই রাতে বান্দার সারা বছরের আমল উত্তোলন করা হয় এবং সারা বছরের রিজিক বণ্টন করা হয়।’ (দাওয়াতুল কাবার [বায়হাকি] ২/১৪৫ হা. ৫৩০)। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে পাঁচ রাতের দোয়া কবুল হয়- জুমার রাত, ঈদুল আজহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, রজবের প্রথম রজনি এবং মধ্য শাবানের রজনি।’ (সুনানে কাবির, ৩/৪৪৫ : হা. ৬২৯৩)

হজরত আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মধ্য শাবানের রজনিতে জাগ্রত থাকো এবং দিনে রোজা রাখো। সূর্যাস্তের সময় আল্লাহতায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছো কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছো কি কেউ রিজিক যাচনাকারী, আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপদগ্রস্ত আছো কি, আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দেব। এরূপ কেউ আছো কি? এরূপ কেউ আছো কি? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ ১/৪৪৪ হা. ১৩৮৮, শুআবুল ইমান ৫/৩৫৪)। এ বিষয়ে এরূপ আরো বহু হাদিস বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে।

উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে অনুমিত হয়, শবেবরাত বা মধ্য শাবানের রজনির গুরুত্ব, মহত্ত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম। এর মধ্যে কিছু ‘সহিহ’, কিছু ‘হাসান’, আবার কিছু ‘জয়িফ’ও রয়েছে শাস্ত্রিক বিশ্লেষণের দিক থেকে। সামগ্রিকভাবে এসব হাদিস গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসিনের বহু উক্তি রয়েছে। শায়খ আলবানি (রহ.) বলেন, ‘শবেবরাত সম্পর্কিত হাদিসগুলোর সারকথা হলো, এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সামগ্রিকভাবে নিঃসন্দেহে সহিহ। হাদিস অত্যধিক দুর্বল না হলে এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিসও সহিহ হিসেবে গণ্য হয়।’ (সিলসিলতুস সহিহা ৩/১৩৮) আল্লামা আবদুর রহমান মোবারকপুরী লেখেন, ‘শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে তা প্রমাণ করে যে এই রাতের ফজিলতের ভিত্তি আছে। যারা শবেবরাতের কোনো শরয়ি ভিত্তি নেই বলে ধারণা রাখে, তাদের বিরুদ্ধে হাদিসগুলো প্রমাণ বহন করে।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি ৩/৩৬৫)

শবেবরাত সম্পর্কে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর মতামতও প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘মধ্য শাবান রাতের ফজিলত বিষয়ে অনেক হাদিস রাসুল (সা.) ও সাহাবা, তাবেয়িরা থেকে বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো শবেবরাতের ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। পূর্বসূরিদের অনেকে এ রাতে নামাজে নিমগ্ন থাকতেন।...অসংখ্য বিজ্ঞ আলেম এবং আমাদের অধিকাংশ সাথি এই মতাদর্শে বিশ্বাসী। ইমাম আহমদ (রহ.)-এর উক্তি দ্বারাও তা-ই প্রমাণিত হয়। কারণ এ বিষয়ে রয়েছে অনেক হাদিস এবং নির্ভরযোগ্য পূর্বসূরিদের অনুসৃত আদর্শ।’ (ইকতিজাউস সিরাতিল হুদা ২/১৩৬)

এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো, শরিয়তে শবেবরাত একটি প্রমাণিত সত্য। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শবেবরাতের সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে আল্লামা তকি উসমানি (দা. বা.) বলেন, ‘১০ জন সাহাবির বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়, রাসুল (সা.) এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন। তাতে কয়েকটি হাদিস সনদের দিক থেকে সামান্য দুর্বল। এসব সনদের দিক দেখে অনেকে বলে দিয়েছেন, এই রাতের ফজিলতের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ মুহাদ্দিস ও ফকিহদের সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বর্ণনার সনদ দুর্বল হলে এর সমর্থক হাদিস থাকলে তার দুর্বলতা কেটে যায়। তবে শবেবরাতের স্বতন্ত্র কোনো ইবাদত নেই, আবার এই রাতের জন্য ইবাদতের আলাদা কোনো নিয়মও নেই।’ (মাহনামা আল-বালাগ-শাবান ১৪৩১ হি.)

শবেবরাতে যেসব আমল করা যায় : এশা ও ফজর নামাজ ওয়াক্তমতো জামাতের সঙ্গে আদায় করা, যথাসম্ভব নফল ও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা, সম্ভব হলে উমরি কাজা নামাজ ও সালাতুত তাসবিহ আদায় করতে হবে। কোরআন মাজিদ বেশি বেশি তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা, বেশি করে দোয়া করা, মাঝে মাঝে শবেবরাতে কবর জিয়ারত করা, পরের দিন রোজা রাখা, সম্ভব হলে রাত জেগে ইবাদত করতে হবে। শবেবরাতে কবর জিয়ারত সম্পর্কে আল্লামা তকি উসমানি বলেন, ‘যেহেতু রাসুল (সা.) এই রাতে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে জান্নাতুল বাকিতে তাশরিফ নিয়ে গেছেন, তাই মুসলমানরা শবেবরাতে কবরস্থানে যাওয়ার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে।’ (প্রাগুক্ত) এ ছাড়া ১৫ শাবান রোজা রাখার কথা রয়েছে। সম্ভব হলে রাত জেগে ইবাদত করতে হবে। একই ইবাদত দীর্ঘ সময় ধরে না করে একের পর এক বিভিন্ন নফল ইবাদত করতে থাকলে তন্দ্রাভাব চলে যেতে পারে। গোটা রাত জাগা সম্ভব না হলে রাতের বেশির ভাগ সময় ইবাদতে মশগুল থাকতে চেষ্টা করতে হবে। তাও সম্ভব না হলে শেষরাতের সময়টুকুতে কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না। আর এ বিষয়টিও খুব খেয়াল রাখতে হবে যে রাতের নফল ইবাদতের কারণে যেন ফজরের ফরজ নামাজ ছুটে না যায়।

শবেবরাতে বর্জনীয় বিষয় : শবেবরাতের নামে কোনোপ্রকার আনুষ্ঠানিকতা কোরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। না কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত বা ইবাদতের নির্দিষ্ট নিয়ম প্রমাণিত আছে। তেমনি জামাতের সঙ্গেও শবেবরাতের নামে কোনো ইবাদত করা যাবে না। যেমন- শবেবরাতের নামে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা ইত্যাদি। শবেবরাতকে কেন্দ্র করে সমাজে কিছু বিদআত ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ১. ঘরবাড়ি, দোকান, মসজিদ ও রাস্তাঘাটে আলোকসজ্জা করা। ২. বিনা প্রয়োজনে মোমবাতি কিংবা অন্য কোনো প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা। ৩. আতশবাজি করা। ৪. পটকা ফোটানো। ৫. মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো। ৬. হালুয়া-রুটি, শিরনি ও মিষ্টি বিতরণের আয়োজন করা। ৭. কবরস্থানে পুষ্প অর্পণ ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি; শরিয়তে এসব কাজের কোনো ভিত্তি নেই।

এসব বিদআত ও কুসংস্কার থেকে আমাদের বেঁচে থাকা আবশ্যক। শবেবরাতকে ফজিলতপূর্ণ করা হয়েছে উত্তম আমল করে বেশি বেশি সাওয়াব অর্জনের জন্য। এর মধ্যে যদি বিভিন্ন বিদআত, কুসংস্কার ও শরিয়তের পরিপন্থী কাজ আঞ্জাম দেওয়া হয়, তাহলে সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহর বোঝাই ভারী হবে। স্মরণ রাখতে হবে, পুণ্যময় রাতগুলোতে ইবাদতে যেমন অধিক সাওয়াব, তেমনি এসব রাতের গুনাহর শাস্তিও অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হবে। (আত-তাবলিগ, খ. ৮, পৃ. ৭৫)

সুতরাং শবেবরাতের ইবাদত বর্জন সম্পর্কে যেমন সতর্ক হতে হবে, তেমনি শবেবরাতের নামে বিভিন্ন বিদআতের চর্চা থেকেও মুক্ত থাকতে হবে। একটি ফজিলতের রাত হিসেবে এটিকে শরিয়তের গণ্ডির ভেতরে থেকেই উদ্?যাপন করতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ এই রাতের বরকত, ফজিলত এবং হাদিস শরিফে উল্লিখিত নিয়ামত অর্জনে আমরা সক্ষম হব। আল্লাহ আমাদের নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close