মাকসুদা আক্তার

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

নিঃসন্তান নারীর হাহাকার!

ফলহীন গাছ এবং সন্তানহীন নারী উভয়ই সমাজের চোখে আগাছা। ফল না হলে গাছ যেমন তুলে ফেলে দেওয়া হয়, তেমনি নিঃসন্তান নারীকেও ছুড়ে ফেলা হয় পরিবার ও সমাজ থেকে। নারীর বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা সবটাই সমাজের এক সূক্ষ্ম জালের আবরণে নিয়ন্ত্রিত। কিছু বিষয় তার নিজেকে সামলে চলতে হয় আবার কিছু বিষয় সমাজ তার ওপর আরোপ করে। যদি বলা হয় একজন নারীর সফলতা কোথায়? বেশির ভাগই বলবে ‘মা’ ডাক শোনার মধ্যে। অথচ সমাজে এমন অনেক নারী আছেন যারা বহু চেষ্টার পরও মা হতে পারে না। সমাজ তাদের বলে ‘বন্ধ্যা’। এসব নারীর সংখ্যা কম হলেও তারা মানুষ। যারা সারাজীবন একটি সন্তানের জন্য হাহাকার করেন কিন্তু তার বদলে পায় অপমান, লাঞ্ছনা। অথচ এ সমাজ, পরিবার ভুলে যায় সন্তান জন্মদানের বিষয়টা প্রাকৃতিক। সে নিজে এই ত্রুটি নিয়ে আসে না অথবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে তার মধ্যে সন্তান জন্মদানের অক্ষমতা থাকলেও আমরা মানুষ হিসেবে তার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করতে পারি না।

নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। এর মাধ্যমে তার সন্তান হওয়ার নিশ্চয়তাকেই সফলতা বলা হচ্ছে পরোক্ষভাবে। মাতৃত্ব দিয়েই নির্ধারণ করা হচ্ছে তার সফলতা, ব্যর্থতার মাপকাঠি। সামাজিক, আর্থিক বা রাজনৈতিক অবস্থানও অনেক সময় ম্লান হয়ে যায় এই মাতৃত্বের কাছে। উত্তরাধিকার রক্ষাই তার প্রধান দায়িত্ব। তাই নিঃসন্তান নারী নিজেও নিজেকে মনে করে ব্যর্থ। এর কারণ পরিবার ও সমাজের নিম্ন মানসিকতায় বেড়ে ওঠা তার মধ্যেও প্রভাব ফেলে।

সন্তান না হলে একজন স্ত্রীকে সইতে হয় সপত্নী জ্বালা, শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন, স্বামীর অত্যাচার কিংবা সমাজের কুৎসিত মানুষগুলোর নেতিবাচক ইঙ্গিত, ভর্ৎসনা। এত কিছু সহ্য করেও অনেকে দিনের পর দিন সংসার করে যায়। অনেকে বাপের বাড়ি চলে যায় অনুগৃহীত হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে। অথচ এর সবকিছুর মধ্যেই আছে নিদারুণ লাঞ্ছনা ও কষ্ট! যার সন্তান নেই তাকে তো মানুষ দিবে সান্ত¡না, ভালোবাসা। তার প্রতি স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে এ সমাজ।

চাইলেই একজন নিঃসন্তান নারী সন্তান দত্তক নিতে পারে। সমাজে এমন অনেক অসহায় শিশু আছে, রয়েছে প্রচুর এতিমখানা। যারা দত্তক নেয় তারা বেশির ভাগই ধনী পরিবারের হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেরই একটা বধ্যমূল ধারণা রয়েছে, ‘এক গাছের ছাল কখনো অন্য গাছে জোড়া লাগে না’। এই দৃষ্টিভঙ্গি এক দিনে তৈরি হয়নি। সন্তানকে মনে করা হয় বংশের বাতি। এই বাতি জ্বালানোর কাজটা বউয়ের পেট কেটেই হতে হবে যেন। অথচ সন্তানের বেড়ে ওঠা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশই তাকে গড়ে তোলে যোগ্য করে।

নারীর আর্থিক স্বাধীনতার বিষয়টিও এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পৃথিবীর যেসব অংশে জনগোষ্ঠীর মোটামুটি উন্নয়ন ঘটেছে, সেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায় না। সবার জন্য সমান সুযোগ বিদ্যমান। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সে সমতা এখনো পুরোপুরি দেখা যায় না। নারীরা অপমান সহ্য করেও তখনই সংসার করে যায়, যখন তার যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না কিংবা আর্থিক দুর্বলতা থাকে।

এই সমাজের কটূক্তিই নারীকে দেয় বিষের যন্ত্রণা। যার সন্তান নেই তার মধ্যে আগে থেকেই থাকে বিপুল শূন্যতা। সেই শূন্যতায় ঘৃণা উৎপাদন করার কাজ করে বৃদ্ধ নানি-দাদি কিংবা শাশুড়ি-ননদ। দিনের পর দিনে শুনে যায় ‘বন্ধ্যা’ শব্দটি। তাকে অনেক আচার-অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয় না। বরং তার উপস্থিতিকে মনে করা হয় অমঙ্গলজনক। এভাবেই সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে কাটে তার সময়।

এর বিপরীতে দু-একটা পরিবারের নিঃসন্তান নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণের পরিবর্তন দেখা গেলেও বৃহৎ পরিবর্তন নয় তা। এ ক্ষেত্রে স্বামীর মানসিক সাপোর্ট এবং পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত সহযোগিতাই পারে একজন নিঃসন্তান নারীকে অপূর্ণ মনে করার ভাবনা থেকে দূরে রাখতে। হতাশা বা একাকিত্ব যেন না হয় তার পরিণতি।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close