মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে শেখ হাসিনা

মিউনিখ জার্মানির একটি অতি পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শহর। শহরটি ক্লাসিক্যাল সংগীত, শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্ব জ্ঞানী-গুণী এবং রাজনীতিবিদদের সম্মেলনের জায়গা হিসেবে পরিচিত। দৃষ্টিনন্দন মিউনিখ মানুষের স্মৃতিতে দীর্ঘদিন টিকে থাকার একটি শহর। এই শহরেই ১৯৭২ সালে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬২ সালে এই মিউনিখে জার্মানির অন্যতম সেরা পুস্তক প্রকাশক ইওয়াল্ড-হেনরিক ভন ক্লিস্ট মিলিটারি সায়েন্স কনফারেন্স আয়োজন করেন। হেনরিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদিও পদাতিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে ৪ বছর কাটিয়েছিলেন। কিন্তু তার পিতা এবং তিনি ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন। হিটলারকে পছন্দ করতেন না, হিটলারকে হত্যা করার জন্য ১৯৪৪ সালে গোপনে তৎপরতাও চালিয়েছিলেন। ধরাও পড়েছিলেন। সাক্ষী-প্রমাণের অভাব থাকায় বিচারের হাত থেকে বেঁচে যান। তিনি শান্তির জন্য পরবর্তী দিনগুলোতে কাজ করতে থাকেন, নিরস্ত্রীকরণের একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালে তার উদ্যোগে মিউনিখ কনফারেন্স অন সিকিউরিটি পলিসি নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর মূলমন্ত্র হলো- সংলাপের মাধ্যমে শান্তি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাবিষয়ক সম্মেলন। প্রথম সভায় প্রায় ৬০ জন প্রতিনিধি ছিলেন। এরপর থেকে দুবার বাদে প্রতি বছর এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৩৫০ জন সিনিয়র ব্যক্তিত্বকে একত্র করে। এই তালিকায় রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সশস্ত্রবাহিনীর উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি, বিজ্ঞান, সুশীলসমাজ, পাশাপাশি ব্যবসা এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রতি বছর এই সম্মেলনের সুনির্দিষ্ট থিম থাকে। এ বছরের থিম ছিল- লস-লস টু উইন-উইন? অর্থাৎ ‘পরাজয়-পরাজয়’ থেকে ‘জয়-জয়’।

এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং সিনিয়র পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পর সরকারের নতুন দায়িত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলনে প্রথম যোগ দেয়। সম্মেলন ১৬-১৮ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলনে অনেকেরই আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ১৬ তারিখ তিনি সম্মেলনে ভাষণ দেন। এতে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিবেচনা করে ৬টি করণীয় তিনি উত্থাপন করেছেন।

প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সঠিক পথের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে তিনি জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান পর্যায় অন্তত দ্বিগুণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থপ্রাপ্তি সুগম করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে হবে। পঞ্চম প্রস্তাবে বলেন, বৈশ্বিক অর্থায়নের ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক ঋণলাভের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ ফল দেখাতে হবে। ষষ্ঠ প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু কর্মসূচির জন্য বেসরকারি পুঁজিপ্রবাহে সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিটি প্রস্তাবই যৌক্তিক ব্যাখ্যাসহ সবাইকে তুলে ধরেন। একদিকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে, এটিকে এখনই মোকাবিলা করার জন্য তিনি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্তাপিত করেছেন। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ-হানাহানি মানুষের বেঁচে থাকার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ অবস্থায় যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তিতে বসবাস করার জন্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জোরালো আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু যেভাবে সদ্য স্বাধীন দেশের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে দেশ-বিদেশে এমনকি জাতিসংঘেও প্রদত্ত ভাষণেও উল্লেখ করেছিলেন, ঠিক তেমনি জাতির পিতাকে অনুসরণ করে তার কন্যাও যুদ্ধ নয় শান্তি চাই এই দর্শনকে ধারণ করেই বক্তৃতা করেছেন। মিউনিখ সম্মেলনে তার বক্তব্য এবং বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনায় একই বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ বিশ্বে যুদ্ধ ও হানাহানি নয় বরং শান্তিতে বসবাস করার নিরাপত্তা বিধানে বিশ্বাস করে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের কণ্ঠই যেন উচ্চারিত হয়েছে।

মিউনিখের হোটেল ব্যেয়ারিসার হফের কনফারেন্স কক্ষে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সাইডলাইনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন সরকারপ্রধান, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি এবং সংস্থার নেতাদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বৈঠকে আলোচনা করেন।

মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানির সঙ্গে শেখ হাসিনা অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গাসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন (এমএসসি) ২০২৪-এর ফাঁকে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শ্লোজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে দুই নেতা বর্তমানে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠককালে তারা পারস্পরিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে (এমএসসি) নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উভয় নেতা বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা পারস্পরিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন (এমএসসি) ২০২৪-এর সাইডলাইনে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানেও পারস্পরিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিত্তে ফ্রেডেরিকসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের আগেই দেশ এবং বিদেশের গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাক্ষাৎ হওয়ার কথা জানাজানি হওয়ার পর সব মহলই এই দুই নেতার মধ্যে কী আলোচনা হয়, তাই নিয়ে গভীর উৎসুক সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় বলেন, আমরা সব ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে। জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার সময় কীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা যায়, সে বিষয়েও তিনি বারবার আলোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন যে যুদ্ধ কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোর জন্য তা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না এবং তাদের জনগণকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।’ প্রধানমন্ত্রী ও জেলেনস্কির মধ্যে আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ স্পষ্টভাবে উঠে আসে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর জেলেনস্কির, যা টুইট করেছেন- ‘ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমরা ইউক্রেনের শান্তির ফর্মুলা ছাড়াও বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। সেই ফর্মুলা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ এবং বৈশ্বিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।’ বৈঠকের সময় অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও জেলেনস্কির মধ্যে আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ স্পষ্টভাবে উঠে আসে। এক প্রশ্নের জবাবে হাছান মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যুদ্ধের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি বলেন, তারা শুধু যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলোচনা করেছেন। সম্মেলনের সাইডলাইনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকে তারা পারস্পরিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। পরে একই স্থানে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক সেক্রেটারি লর্ড ক্যামেরন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর জার্মানিতে বার্গারহাউস গার্চিংয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কমিউনিটি রিসেপশনে যোগদান করেন। প্রবাসীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, তাদের অর্জিত রেমিট্যান্স যেন তারা বৈধ উপায়ে দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী ১৯ তারিখ দেশে ফিরে আসেন এবং সম্মেলনে তার উত্থাপিত শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রস্তাবগুলো বর্তমান বিশ্বে যারা যুদ্ধ, হানাহানি এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, আন্দোলন করছেন তাদেরই কথার যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close