প্রীতম দাস

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবনতির জন্য দায়ী কে

দুর্নীতি হচ্ছে অপ্রীতিকর বা প্রতারণামূলক আচরণে ক্ষমতার অপব্যবহার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যাপক মরিস বলেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তির আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত।

সম্প্রতি জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম, যা ২০২২ সালে ছিল ১২তম এবং ২০২১ সালে ছিল ১৩তম। প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির হার বেশি।

বাংলাদেশে দুর্নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং যথাযথ সুশাসনের ঘাটতি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শুধু সরকার সচেতন হলে চলবে না। সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে হবে। অন্যথায় এ দেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হবে।

বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতি বিরাজমান। কোনো দেশের পক্ষে শতভাগ দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো হচ্ছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও সোমালিয়া। সর্বনিম্ন দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। বিশেষ করে আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে দুর্নীতি বেশি হয়। কারণ এই দুই মহাদেশের অধিকাংশ দেশই উন্নয়নশীল দেশ।

বাংলাদেশে দুর্নীতি অবনতির জন্য দায়ী কে? দুর্নীতি নেই এমন কোনো স্তর বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরেই কমবেশি দুর্নীতি প্রতিফলিত হয়। আমাদের দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হলে সর্বপ্রথম নিজের ভেতরের নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মানবিকতা জাগ্রত করতে হবে। প্রতিদিন পত্রিকা হাতে নিলে দেখা যায় যেকোনো না কোনো জায়গার দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। মানুষ যতটুকু পায় ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না, তার লোভ-লালসা অধিক পরিমাণে পর্যবসিত হয়। যেমন : একজন স্নাতক পাস করা শিক্ষিত যুবক তার কিছুতেই চাকরি হচ্ছে না, কিন্তু তার বাবার অঢেল সম্পত্তি। সে জন্য তার বাবা কোনো এক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বলবে আমার ছেলের জন্য আপনার প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিতে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, আপনার যাবতীয় যা লাগে আমি তা ব্যবস্থা করব। এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢোকে অনির্বাচিত ও অযোগ্য প্রার্থী। যার ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের মান নিম্নমুখী ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

দেশের প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি টেবিলের অন্তরালে বিরাজমান হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুর্নীতি দমনে বিভিন্ন সময় অভিযান চালায় প্রশাসন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সাধারণ জনগণের ভেতরের দুর্নীতিগ্রস্ত চিন্তাভাবনা যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে অভিযান চালিয়ে ফলপ্রসূ হবে না। সেজন্য জনগণের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে হবে।

একজন চাইলেই আমি দেব কেন? তাদের বিরুদ্ধে আমরা একত্র হব। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে জনগণই মুখ্য। দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদিও কোনো দেশের পক্ষেই শতভাগ দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে আমাদের সরকারের একটা দায়িত্ব হলো এই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা, যাতে এটি দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে এবং আমাদের সব সাফল্য ম্লান করে না দেয়।’

বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে হলে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের ভূমিকাই মুখ্য।

সম্প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহনশীলতা) দেখানো, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেওয়াসহ নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নামে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা ২০০৪ সালে গঠিত হয়। সংস্থাটি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করেছে।

যদি প্রতিটি নাগরিকের ভেতর মনুষ্যত্ববোধ, আদর্শ, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ জাগ্রত হতো তবে হয়তো বা সরকারের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হতো না। যত দিন পর্যন্ত না এ দেশের মানুষ ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারবে না, তত দিন পর্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত হবে না। নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সামাজিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মানুষ যেসব নীতি, আদর্শ এবং সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত অনুশাসন মেনে চলার সমষ্টি। আর, মূল্যবোধ হচ্ছে ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের সদস্যদের ধারণা এবং মূল্যবোধ ও নৈতিকতাই নীতিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।

অর্থাৎ নাগরিকের নীতিশাস্ত্র অধ্যয়ন জরুরি। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সমাজে প্রতিটি নাগরিকের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, তা না হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। কারণ যে নাগরিক ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিতের পার্থক্য নির্ধারণ করতে জানে না, যে নাগরিকের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারণা নেই সেই নাগরিক দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে না। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে পরিবার ও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা সম্পর্কে অবগত করতে হবে। শিশুদের উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। কারণ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পারলে সমাজে দুর্নীতির মাত্রা কমে আসবে। নৈতিক মূল্যবোধের পাশাপাশি প্রতিটি ব্যক্তিকে ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কেও অবগত করা জরুরি। কারণ সমাজে দুর্নীতির মাত্রাবৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব। সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারলে এ সমস্যার সমাধান খুব সহজে হবে। তার জন্য প্রতিটি মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় দুর্নীতির ধর্মীয় কুফল সম্পর্কে আলোচনা করলে মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি হবে। কোনো ধর্মই দুর্নীতিকে প্রাধান্য দিতে শেখায় না। ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি রাষ্ট্রে সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। কারণ সুশাসন হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন, যেখানে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে, সর্বোচ্চ স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকবে, আইনের শাসন থাকবে, নীতির গণতন্ত্রায়ণ থাকবে, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে, মতামত ও পছন্দের স্বাধীনতা থাকবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকবে। সে জন্য ব্যক্তির নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তাহলেই একটি দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত থেকে দুর্নীতিমুক্ত হবে। সুতরাং জনগণের চিন্তাভাবনা দুর্নীতিমুক্ত হলেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close