মমতাজ লতিফ

  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মতামত

বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্ব

নতুনভাবে প্রণীত বাংলা মাধ্যম সাধারণ শিক্ষার শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতাকে শিখন-শিক্ষণে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী তাদের বাংলা ভাষা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, নৈতিকতাসহ অন্যসব বিষয়ের নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করবে- এমনটাই নির্ধারণ করা হয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে, দেশের শিক্ষার্থী, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক মিলে সিংহভাগ বাংলা মাধ্যমের স্কুলে অর্থাৎ মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

শোনা যাচ্ছে, নতুন বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাক্রমে বিষয়বস্তু মুখস্থ করা, না থাকা ও বাড়ির কাজ না রাখার কারণে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! এর ফলে, এই শিশু-কিশোরদের আকস্মিকভাবে ভিন্ন, অনভ্যস্ত পরিবেশে নিয়ে ফেলবে, যা তাদের লেখাপড়ার মান বিনষ্ট করে দিতে পারে। তা ছাড়া, দীর্ঘদিনের সঙ্গীসাথি, স্কুলের পরিচিত শিক্ষকদের হারিয়ে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে বলে গভীর আশঙ্কা হয়।

কেননা, শিক্ষাগ্রহণ শুধু কতক বই মুখস্থ করা নয়, এর সঙ্গে বন্ধু-সঙ্গী-সাথিদের সাহচর্য এবং পরিচিত স্কুলকক্ষ, মাঠ, শিক্ষক-শিক্ষিকার অবস্থান শিক্ষার্থীর মনে গভীর সম্পর্ক দ্বারা বাঁধা এক উপভোগ্য জীবনের অংশ। স্কুলজীবন এ কারণে জীবনের অতুলনীয় একটি অধ্যায় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।

এর বাইরেও রয়েছে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার আরো অনেক ইতিবাচক দিক। প্রথমেই শিক্ষার্থীরা স্কুলের শুরুতে জাতীয় পতাকা তুলে জাতীয় সংগীত গেয়ে ক্লাস শুরু করে, যা বাংলা মাধ্যম স্কুলেই রুটিন কাজ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন প্রভাতে স্কুলের শিক্ষার শুভ সূচনা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে হয় না বললেই চলে। প্রভাতের এই অনুষ্ঠানটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মনে পবিত্র স্বদেশপ্রেমের যে ভাবটির সৃষ্টি করে, এ সত্য কোনো শিক্ষার্থীই অস্বীকার করতে পারবে না।

আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে, বাংলা ভাষার মাধ্যমেই সব বিষয় পড়াশোনা করার কারণে শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষার বড় লেখকদের গল্প-কবিতাণ্ডপ্রবন্ধ পড়া এবং বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখক-লেখিকাদের দশ-বারো বছরের শিক্ষাজীবনে বাংলা পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে পড়তে শেখে। তাদের রচনাকে ভালোবাসতেও শেখে। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের স্কুল পাঠাগার থেকে নানা লেখকের লেখা বাংলা গল্পের বই নিয়ে বাড়িতে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে, যা তাদের মাতৃভাষার সাহিত্যের ভাণ্ডারের সঙ্গে কিছুটা বিশদ পরিচয় সৃষ্টি করে।

ভাষাসম্পর্কিত নানা রচনা ও ভাষাশহীদদের আত্মদান জানে তারা। এ থেকে বাংলা ভাষার শহীদদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করে। তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করার তাগিদ স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে জন্ম নেয়। এটি দেশপ্রেমকে তাদের হৃদয়ে আরো দৃঢ় ভিত্তি দান করে, যার মূল্য অসীম। অন্যদিকে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মনে বাংলা গল্প-কবিতার বই পড়ায় যে অনীহার জন্ম হয়, তা তাদের মাতৃভাষা বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের চিনতে, তাদের রচনা বুঝতে, তাদের প্রতি তাদের মনের আন্তরিক আকর্ষণ কোনোভাবেই সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় না। ফলে তারা বাঙালির সমাজে যেন কিছুটা বাইরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করে। ফলে, তারা তাদের দেশপ্রেমের ভিত্তিকেও ততটা দৃঢ় করতে পারে না।

আমাদের ভাষা এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকালে এ কথাগুলো স্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে, বাংলা মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীর ছেলেমেয়েরাই পাকিস্তানি শাসকের দ্বারা রাষ্ট্রভাষা উর্দুর অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভাষা আন্দোলন সংঘটন করে। এই আন্দোলনে মাতৃভাষা বাংলাকে মায়ের সম্মান দিয়েছিল গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা।

কৃষক ও গ্রামের সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অনেক ছাত্রনেতা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে সময় যদিও ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ ছিল না, তবু এ কথা আজকের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের দেখে অনুমান করা কঠিন নয় যে, বাংলা ভাষাকে বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা যেভাবে প্রাণের ভাষা বিবেচনা করেছে, সে বিবেচনা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় না থাকা ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার শিক্ষার্থীদের কাছে কখনো সম্ভব হতো না।

পরবর্তীকালে পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক সারা দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ছয় দফা, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে বিদেশি শাসকমুক্ত করার জন্য জানবাজি রেখে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল এবং পরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে যোগ দিয়ে লাখো প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, তারা সবাই বাংলার গ্রামের কৃষক-শ্রমিক-মফস্বল শহরের ছাত্র-শিক্ষক-ডাক্তারসহ নানা পেশার মানুষ।

তারা বাংলা সাহিত্যের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুলের গান গেয়ে, বাংলার লোক গান গেয়ে নিজ দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল বলেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানগুলোকে নিজেদের করে নিয়েছিল। এ কাজটি বাংলা সাহিত্যকে না চেনা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্ভব হতো না। কারণ, ওরা কোনো বাংলা গল্প-কবিতার বই পড়ে না। যে কারণে ওদের বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি আত্মিক টান সৃষ্টি হয় না।

এমনকি, রাজপথে দুই কলেজছাত্র, ছাত্রীর বাসচাপায় মৃত্যুর পর পুরো ঢাকার রাজপথ জুড়ে যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল, তাদের অধিকাংশ প্রায় সবাই ছিল বাংলা মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে

তরুণদের যে গণজমায়েত হয়েছিল, তাও সর্বাংশে বাংলা

মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ছিল।

সাধারণত, বাংলা মাধ্যমে স্কুলে নিয়মিত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তাতে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে বাংলা সংস্কৃতিকে চেনে, জানে, চর্চা করে এবং এসব নির্মল বিনোদনের দ্বারা শিক্ষার্থীদের মনে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি প্রাণের টান তৈরি হয়। ইংরেজি মাধ্যমে কিছু সুনির্দিষ্ট স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও অধিকাংশ স্কুলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা প্রায় হয় না বললেই চলে। ফলে, শিক্ষার্থীরা স্বদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ থেকে যায়।

ইংরেজি মাধ্যমের দুই ধারার শিক্ষা-ক্যামব্রিজ ও এডএন্সেল-এর শিক্ষাক্রম থেকে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাক্রমণ্ডবাংলা, গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিকতা বিষয়গুলোর শিক্ষাক্রম তুলনায় অনেক অগ্রসর। পশ্চিমা দেশে আমাদের দেশ থেকে যেসব গবেষক, পিএইচডি শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণা করছে।

প্রায়ই দেখা যায়, গ্রামের কোনো স্কুলশিক্ষার্থী কোনো কৃষি বা স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির লক্ষ্যে কোনো একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। কেউ বা উন্নত সেচযন্ত্র আবিষ্কার করেছে। কেউ কম জ্বালানির গাড়ি বানিয়েছে। তরুণ নেতৃত্ব হিসেবে যারা পুরস্কৃত হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী। গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিকস অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড ইত্যাদিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলা মাধ্যমের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এসব প্রতিযোগিতায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে না।

‘বিজ্ঞানচিন্তা’ ম্যাগাজিনে গণিত, ফিজিকস, রসায়নের যেসব কুইজ থাকে, সেগুলোর সমাধান করে নিয়মিত পুরস্কৃত হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জনপদের সাধারণ বাংলা মাধ্যমের স্কুলের শিক্ষার্থীরা। অবশ্য, বাংলা এই ম্যাগাজিনটি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পড়ে না বা এই বাংলা পড়ে ওরা বুঝতেও পারবে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের, বাংলা সংস্কৃতির জ্ঞান ওদের শিক্ষার মানকে সীমিত করে রাখে।

আশ্চর্য হয়ে দেখি ‘বিজ্ঞান চিন্তায়’ যে শিক্ষার্থীরা পত্র লেখে, তারা বিজ্ঞানের অনেক খুঁটিনাটি জ্ঞান রাখে, অতি কৌতুহলী এবং তাদের প্রশ্নগুলো অত্যন্ত উঁচুমানের। শিক্ষার্থীরা বাঁশখালী, কচুয়া, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার ইত্যাদি প্রত্যন্ত স্থানে অবস্থিত বাংলা মাধ্যম স্কুল থেকে চিঠি লিখেছে! বিজ্ঞানে তাদের আগ্রহ ও জ্ঞান দেখে অবাক হই এবং গর্ববোধ করি।

বলা চলে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আগ্রহী বেশি, যাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসবে না। অন্যদিকে দেখা যায়, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ফিরে এসে দেশের জন্য কাজ করতে আগ্রহী থাকে। অনেকে মনে করে, ইংরেজি মাধ্যমে কোচিং নেই। ওখানে ক্লাস নেওয়ার মতো কোচিং হয়, যা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থী গ্রহণ করে থাকে।

সবশেষে দেখা যায়, যেকোনো অন্যায় অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে এগিয়ে আসে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই। তারা ছোটবেলার প্রাথমিক থেকে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের কথা যেমন পড়ে, তেমনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি চিনতে শেখে। সমাজে দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে জানে। সম্প্রতি তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথা জেনেছে। এভাবে তাদের মনে সমাজের সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতির জন্ম হয়, যা তাদের উদার, সংস্কারমুক্ত মানবিক মানুষে পরিণত করে। আমাদের ভয় নেই। দুর্যোগে-দুঃসময়ে এই উদার শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণ প্রজন্ম জাতিকে উদ্ধার করে বিজয়ী হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close