মোন্তাসির আবিদ সাবির
মুক্তমত
মাদকের ভয়াল থাবায় যুবসমাজ
মাদকাসক্তি এক ভয়াবহ মরণব্যাধি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেসব সমস্যা বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মাদকের ভয়াল থাবা। যেসব দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার নেতিবাচক অবনতি ঘটায় এবং এই দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি পায় তাকেই মাদক বলে। দিন দিন মাদকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাদকের বেচাকেনা হয় না। শহর থেকে শুরু করে গ্রামেও এটি সহজলভ্য। মাদক হলো একপ্রকার রাসায়নিক দ্রব্য, যা ব্যবহারে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পরে। মাদক শুধু মাদকাসক্তের জন্ম দেয় না, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদকের বিষবাষ্প ছড়ায়। আমাদের দেশে প্রচলিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ, আফিম, হিরোইন, কোকেন, প্যাথেডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠাও রয়েছে। এসব ভয়ানক নেশা জাতীয় দ্রব্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। এসব মাদকের বেশির ভাগই আসে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছেন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শত শত নদ-নদী দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্র উপকূল ও জলপথকে তাদের পণ্য পাচারের খুবই উপযুক্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মাদকের রুট। বাংলাদেশের যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত।
দিন দিন যুবসমাজের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। তরুণদের মধ্যে ধূমপান একটি ফ্যাশন বা স্মার্টনেসে পরিণত হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই তরুণ-তরুণী! বিশালসংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদক সেবনে মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন হয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে। এসব জীবনবিধ্বংসী ক্ষতিকারক দ্রব্য সেবনের ফলে যুবসমাজের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। এরই পরিণাম স্বরূপ ছেলেমেয়ের হাতে বাবা-মা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি এখনকার নৈমিত্তিক ঘটনা। বছর কয়েক আগে মাদকাসক্ত তরুণী ঐশীর হাতে পুলিশ অফিসার বাবা-মা খুন হওয়ার ঘটনা সবারই জানা। মাদকের এসব ভয়াবহ প্রভাব থেকে সন্তানদের রক্ষার জন্য অভিভাবকসহ পুরো জাতি আজ শঙ্কিত। মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। এছাড়া পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা ইত্যাদি কারণেও যুবসমাজ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদক পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ও শৈশব থেকে তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে ও সিনিয়রের সাহচর্যে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা হলেই বড় ক্যাম্পাসগুলোয় মাদকের আসর বসে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চললেও অভিযান চালানো হয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরাপদে মাদক গ্রহণের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হচ্ছে। অনেক বহিরাগত নিরাপদে মাদক সেবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ভিড় করে। ক্যাম্পাসে অবাধে মাদকের বিচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীকে মাদক সেবনের প্রতি প্রভাবিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মাদকের বিস্তার রোধ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি হলে পরামর্শদাতা নিয়োগ দিতে হবে এবং প্রতি বছর ভর্তি প্রক্রিয়ায় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাদকের এই নীল দংশন থেকে যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। এছাড়া দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং মাদক চোরাচালানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে থেকে তারা তাদের বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা। স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : শিক্ষাথী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"