মো. জিল্লুর রহমান
বিশ্লেষণ
হারিয়ে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার
একবিংশ শতাব্দীতে একক বা ছোট পরিবার নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি- ছোট পরিবার মানেই সুখী পরিবার! স্বামী, স্ত্রী এবং একটি কিংবা দুটি সন্তান নিয়ে পরিবার। কয়েক দশক আগেও বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি নিয়ে ছিল একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকাণ্ডখাওয়া, হই-হুল্লোড়, আনন্দ-উৎসবের মজাই আলাদা। একান্নবর্তী পরিবার যে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। শহুরে জীবনের ঢেউ গ্রামেও লেগেছে। গ্রাম থেকেও যৌথ পরিবার উঠে যেতে বসেছে। মানুষের পুকুর ভরা মাছ ছিল, খেতজুড়ে ধান ছিল, গোয়ালভরা গাভি ছিল, একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। অবস্থাভেদে প্রতিটি পরিবারে সদস্য ছিল ২০ থেকে ৩০ জন। কোথাও আবার তার চেয়ে বেশি। পরিবারের কর্তার আদেশ সবাই মান্য করে চলত। ভাই-বোনের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকত। বিবাহবিচ্ছেদ হতো কম। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, একান্নবর্তী পরিবার তত কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধন, বাড়ছে কলহ-বিবাদ আর নানা অশান্তি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বসাম্প্রতিক এক তথ্য বলছে, পরিবারের সদস্যের আকার ছোট হয়ে চারজনের নিচে নেমে গেছে। এক দশক আগে ছিল প্রায় সাড়ে চারজন। বর্তমানে সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ জন। পরিবার ছোট হওয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমেছে। দেশে এখন বার্ষিক গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং এক দশক আগে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত ২৯ নভেম্বর ২০২৩ প্রকাশিত বিবিএসের সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে এবং চিত্রটি অবশ্যই উদ্বেগের। দেশজুড়ে ২০২২ সালের ১৫ থেকে ২১ জুন ষষ্ঠ জনশুমারি অনুষ্ঠিত হয় এবং একই বছরের ২৭ জুলাই শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ। ২৯ নভেম্বর ২০২৩ প্রকাশিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ, এর মধ্যে নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার (৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ) এবং পুরুষ ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার (৪৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ) অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারী প্রায় ১৬ লাখ বেশি। নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর আয়ুষ্কাল বেড়েছে এবং অনেক পুরুষ প্রবাসী। সে কারণে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একান্নবর্তী পরিবার এখন পাখির বাসার মতো ক্ষণস্থায়ী ছিন্ন জীবন সংসার। একটি-দুটি ছোট ঘর, ছোট সংসার, ছোট পরিবার; যেখানে বসবাস করে শুধু মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলেমেয়ে। যেখানে নেই তেমন আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ ও নিঃসঙ্গ। আগের সেই একান্নবর্তী পরিবারে যারা কর্তা-কর্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। ফলে তারা যে পরিবারের সদস্য সেটা শিশুরা জানছেই না, ওদের মধ্যে দাদা-দাদি, চাচা-ফুফিদের প্রতি কোনো ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতা গড়ে উঠছে না। এই না জানার মূলে রয়েছে ওদের বাবা-মা। এসব পরিবারের সন্তানগুলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও বাদ যাচ্ছে না। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যার ফলেই বৃদ্ধাশ্রম। এ ছাড়া বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে, তার জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী।
যুগের হাওয়ায় যৌথ পরিবার ভেঙে যেতে যেতে পরিবারের সদস্যসংখ্যা এখন তিনজন কিংবা চারজনে এসে ঠেকেছে। তদুপরি সবাই ব্যস্ত। এখনো যখন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একান্ত আলাপচারিতা দেখি, অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্মৃতিচারণ করেন। পরিপূর্ণ আনন্দ যে ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে নিহিত, অবলীলায় সবাই স্মরণ এবং স্বীকার করেন। এখন তো যান্ত্রিক শহর জীবনে ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দ করে বিয়ে করলেই মা-বাবা বেশ খুশি হন। দিন দিন সামাজিক রীতিনীতি বদলাচ্ছে, মানুষের মূল্যবোধ পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের অনুশাসন কাঠামো। মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা যত বাড়ছে, জীবনযাপনের স্বাধীনতাও ততটাই ভোগ করতে চাইছে। পরিবারগুলো ভাঙছে। সমাজও তার আদল বদলাচ্ছে। জীবনযাপনের পুরোনো রীতিগুলোও পাল্টাচ্ছে।
একক পরিবারে প্রত্যেকের গোপনীয়তা রক্ষা হয়। নিজের ইচ্ছেমতো চলা যায়। আয়-ব্যয় সঞ্চয় ভবিষ্যৎ নিজের মতো রক্ষিত হয়। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার হলো একটি বটবৃক্ষের মতো অর্থাৎ যৌথ পরিবারের সুবিধা একক পরিবারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। যৌথ পরিবার হলে বিপদে-আপদে অনেককে পাশে পাওয়া যায়। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয় যায়। একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের সদস্যদের সবার একে অন্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, আদর-স্নেহ ইত্যাদি সব সময়ই অটুট থাকে। যেকোনো বিপদে-আপদে কিংবা উৎসব, পালাপার্বণে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদেরই সবচেয়ে বেশি সুবিধা এবং আনন্দ হয়।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতে, ‘যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এ ক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন বাবা, মা এবং শিক্ষক।’ বর্তমানে অনেক বাবা-মা আত্মীয়স্বজন থেকে আলাদা থাকার মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে চলেছেন। কতটা বোকা চিন্তাভাবনা! আধুনিকতা মানেই নিঃসঙ্গতা নয়। একা একা যদি বসবাস করতে চান, তবে রবিনসনের মতো নির্জন দ্বীপে বসবাস করা শ্রেয়!
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, একান্নবর্তী পরিবার আর সমাজে ধরে রাখা সম্ভব না। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি। যেমন জাপানে একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। সেখানে তো বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তার পরও তারা এটা ধরে রেখেছে এবং এর সুফলও ভোগ করছে। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ পরিবার ধরে রাখার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আধুনিক নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অবস্থা এবং পারিবারিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রবীণ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। পারিবারিক ভাঙনে যৌথ পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রবীণরা। যার কারণে শেষ বয়সে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া প্রবীণদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী পরিবার থেকে আসা। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন। যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত। ফলে সম্মানের ভয়ে শেষ ভরসা হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকেই বেছে নিয়েছেন।
বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তাদের প্রায় শতভাগ উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তশালী পরিবারের। এদের কারো সন্তান বিদেশে। তাকে দেখার কেউ নেই বলে এখানে আশ্রয় নেন। আবার এমনও আছে সন্তানের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সব ছেড়ে নিরাপদ আবাসন হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকে সঙ্গী করেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা স্বজনবিহীন জীবন কাটান তারা। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে পারিবারিক স্মৃতি স্মরণ করে চোখের পানিতে সান্ত¡না খুঁজেন। আবার এমন ঘটনাও ঘটে যে, একজন মারা গেলে জানানোর পর সন্তানরা লাশও নিতে আসে না।
সমাজবিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রমাগত সময় যেন সবকিছুকেই যান্ত্রিক করে দিচ্ছে। পরিবার, সম্পর্ক, হৃদ্যতা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোনের মনিটরে। বাঙালি পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ঝরনায় সিক্ত ছিল, সেখানে যেন বিচ্ছিন্নতার গল্পহীন ধুলোর আস্তরণ জমেছে। আবেগের পলেস্তরাগুলো ক্রমেই ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাস্তব জীবনের পরিবর্তে এক ভার্চুয়াল জীবনে রূপ নিয়েছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পরিবর্তে হাই হ্যালোর মধ্যেই সবকিছু আটকে যাচ্ছে। যেন এক রসকষহীন কাঠখোট্টা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে এবং ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারের রূপ-রস-গন্ধ ও ভালোবাসার চিরাচরিত বন্ধন। পারিবারিক সম্পর্কের স্বপ্ন এখানে ধুলো জমা পিয়ানো, গিটার, ভায়োলিন, সেতার, এস্রাজ, তানপুরা হারমোনিয়ামের অবয়বের মতো অবরুদ্ধ। এখন ‘একক পরিবার’ সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। শহুরে নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির অপূর্বময়তার সংস্পর্শ থেকে আজ বঞ্চিত। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় চরম সংকটে পড়ছে ছোট পরিবারগুলো!
আধুনিকতার কারণে দিন দিন বদলে যাচ্ছে মানুষ। নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশসহ বিভিন্ন কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা কমে আসছে। এসব কারণে শহর তো দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামেও ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে। সন্তানরা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রীর একক পরিবার গড়ে তুলছে। ফলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন।
লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
"