সুস্মিতা চক্রবর্তী

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩

মতামত

অনলাইন জুয়ায় নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন জুয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। পরিতাপের বিষয় হলো গ্রাম ও শহরে ব্যক্তিগতভাবে দুজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ফলাফল বা অন্য কিছু নিয়ে বাজি ধরে বিজয়ীকে অর্থ বা মূল্যবান বস্তু আদান-প্রদানের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। খালি চোখে এটি নিছক একটি চ্যালেঞ্জ মনে হলেও এর উদ্দেশ্য মহৎ বলা যায় না। বাজি ধরা, অর্থ কিংবা পণ্যের বিনিময়ে প্রতিযোগিতা, লটারি, অর্থ বা আর্থিক মূল্যমানের কোনো পণ্যের বিনিময়ে ভাগ্য কিংবা ভাগ্য ও দক্ষতার সংমিশ্রণে কোনো আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ খেলা ইত্যাদি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। রাস্তাঘাট, ক্লাব, অভিজাত এলাকা, এমনকি নিজেদের ঘরের ভেতরেও একা অথবা কয়েকজনের সঙ্গে জুয়ার আসর বসার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এই জুয়ায় গুটিকয়েক লোক লাভবান হলেও বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লোভের ফাঁদে পড়ে বেশি লাভের আশায় শেষে নিঃস্ব হয়। এভাবে তরুণ প্রজন্মসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য বিরাট হুমকি। বর্তমানে চাকরির বাজারে প্রয়োজন যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন কিন্তু জুয়ায় আসক্ত তরুণরা দক্ষতা অর্জনের চেয়ে সহজে অর্থলাভের আশায় জুয়া খেলতে অধিক আগ্রহী। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া বা ব্যবসায় অগ্রগতি করার ধৈর্য কমে যাওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ্য লোক না পেয়ে দেশে এত বেকার থাকতেও বিদেশিদের উচ্চ বেতনে কাজে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন, যা কখনোই কাম্য নয়।

আগে এসব জুয়া খেলতে সরাসরি দেখা যেত কিন্তু বর্তমানে এই জুয়া ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ পেয়েছে। এর ফলে ঘরে বসেই মানুষ অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন। এসব অনলাইন জুয়ায় আসক্ত বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্ম, যা বাংলাদেশের জন্য একটি অশনিসংকেত। স্বল্প পরিশ্রমে বেশি লাভের আশা দেখিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কুপথে চালিত করা হচ্ছে। এখন মা-বাবাসহ অভিভাবকরা অনলাইনে জুয়া খেলা যায় এসব বিষয়ে না জানার ফলে তাদের আদরের সন্তানরা মুঠোফোনের মাধ্যমে পড়াশোনা করছে নাকি জুয়া খেলছে, বুঝতেও পারেন না। ফলে শাসন করারও সুযোগ থাকছে না।

জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন যেমন বাংলাদেশের কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যায়, তেমনই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলগুলোয় প্রচার হতেও দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে খুব সহজেই প্ররোচিত করা যায়। এই সুযোগের অপব্যবহার করে তাদের জুয়ার দিকে আকৃষ্ট করা হয়। তরুণদের সামনে জুয়ার অ্যাপগুলো খেলার মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা দুঃখজনক, কারণ তাদের ভুল বুঝিয়ে ভিন্ন দিকে প্ররোচিত করা হচ্ছে। এটি যেমন খারাপ, তেমনি ক্ষতিকর। যেহেতু তরুণদের ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা কম থাকে, তাই তারা অতি সহজেই এই ফাঁদে পা দেয়। নিজেরা জুয়ায় আসক্ত হওয়ার পাশাপাশি তাদের বাবা-মাকেও অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে টাকা ও সম্পদ বিনিয়োগ করায়। অবশেষে কেউ হারাচ্ছে সারাজীবনের জমানো টাকা, সম্পদ, বাড়িঘরের মালিকানা। এমনকি মেয়ের বিয়ের জন্য, ব্যবসা করার মূলধনও জুয়ায় দিয়ে পরে সব হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে।

অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অথবা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ-সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরা হয়। বাজির লেনদেনের জন্য জুয়াড়িরা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যম (যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপাল, পাইওনিয়ার ইত্যাদি) এবং বিটকয়েনসহ অন্য যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।

কারণ এতে সহজে ধরা পড়ার ভয় নেই। জুয়ায় কখনো কখনো সহজে টাকা আয় করা যায় প্রাথমিকভাবে। এটিও জুয়ার প্রতি মানুষকে আকর্ষিত করার ফাঁদ। কয়েকবার স্বল্প পরিমাণে টাকা পেয়ে যারা জুয়া খেলেন, তারা লোভে পড়ে যান। কম পরিশ্রমে বেশি লাভের জন্য এরপর জুয়াড়িরা বেশি টাকা দেন জুয়ায়। যখন দেওয়া মূল টাকা ফেরত আসে না, তখন পরেরবার নিশ্চয়ই ফেরত পাব, এই আশায় আবার টাকা খরচ করেন তারা। পরবর্তী সময়ে সেই টাকাও না পেলে দিশাহারা হয়ে ওই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো উপায় না পেয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বারবার টাকা দিতে থাকেন জুয়ায়।

বাংলাদেশে ক্রিপোকারেন্সি বৈধ নয় কিন্তু অধিক লাভের মিথ্যা আশায় অন্ধ মানুষরা বেআইনি পথে যেতে দুবারও ভাবেন না। তাদের কাছে নীতিনৈতিকতার চেয়ে লোভের মোহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয় এই যে, ঝুঁকি নিয়ে জুয়া খেলে, জমানো টাকা বিনিয়োগ করেও তারা পায় না লাভের দেখা। আরো আইনের দৃষ্টিতেও হয়ে পড়ে অপরাধী। এতে হিতে-বিপরীত হয়। নিজেকে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা মনে করে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। দেশ হারায় সম্ভাবনার আধার একজন কর্মক্ষম মানুষকে।

অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, যা বেশির ভাগ সময় পাচার হয় বিদেশে, কারণ এসব জুয়ার অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের অধিকাংশ মালিক বিদেশি। এ জুয়ার খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। যারা জুয়া খেলেন, তাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। তাদের পারিবারিক বন্ধনও শিথিল হয়ে পড়েছে। জুয়ার টাকা জোগাড় করার জন্য চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করতেও আসক্তরা দ্বিধাবোধ করেন না। অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাও ঘটছে। কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যাধিকভাবে। তরুণরা নৈতিক-অনৈতিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে এখন জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। পড়াশোনা করার আগ্রহ প্রতিনিয়ত তরুণদের মধ্যে কমে যাচ্ছে। কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা কিছুই তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ চাকরি বা ব্যবসা করার চেয়ে মানুষরা জুয়াকেই সহজ ও সুফলদায়ক বলে মনে করছে। জুয়ায় সফলতা পাওয়াকে নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচায়ক এবং জুয়ায় বিফলতাকে ব্যর্থতা ভেবে আত্মহত্যার মতো প্রাণহানিকর কাজে উদ্বুদ্ধ হতেও পিছপা হচ্ছে না। নিজেদের জীবন নেওয়া ও অন্যদের জীবন কেড়ে নেওয়া তাদের কাজে অনলাইন দুনিয়ার মতো সহজ ও স্বাভাবিক মনে হয়। এভাবে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাবে মানুষের প্রতিদিনের কাজকর্মের ধরন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এবং মানবিক মূল্যবোধও কমে যাচ্ছে।

বিদ্যমান প্রকাশ্য জুয়া আইন-১৮৬৭-এর ধারা ও প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিছু দুর্বলতার কারণে বর্তমানে এর প্রয়োগ বেশ কঠিন। ওই আইনে ‘ক্যাসিনো’ শব্দটি নেই। অনলাইন জুয়ার প্রতিরোধের জন্য সময়োপযোগী আইন তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশ গড়বে। তাই তারা যেন অনলাইন জুয়ার মতো ক্ষতিকর আসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সরকার চাইলে ওয়েবসাইট, অ্যাপ ও যেসব মাধ্যম ব্যবহার করে জুয়াড়িরা জুয়া খেলেন, সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। যেসব ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমগুলো জুয়ার লেনদেনে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা ওই কার্ডগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে।

অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানরা মুঠোফোন ব্যবহার করে কী করছে, তা ভালো নাকি ক্ষতিকর, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ছেলেমেয়েদের আলাদা রুমে মুঠোফোন ব্যবহার করতে না দিয়ে সবার সামনে ব্যবহার করার নির্দেশনা দিলে অনলাইন জুয়া খেলার প্রবণতাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। অনলাইন জুয়ার কুপ্রভাব সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকগুলোতে জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করাও সুফল বয়ে আনতে পারে। অভিভাবকদের অনলাইন জুয়ার লক্ষণ, প্রভাব এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানানো যেতে পারে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সুশীলসমাজ, রাষ্ট্র সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার কবল থেকে তরুণ প্রজন্মকে মুক্ত করা যায়। যার ফলে সুখী, সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close