মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি

বেশ কিছুকাল ধরে দেশে বারবার মৃদু এবং মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানছে। এসবের উৎপত্তিস্থলও খুব দূরে নয়, দেশের অভ্যন্তরে অথবা খুব কাছাকাছি কোথাও। সম্প্রতি মাত্র ৯ দিনের মধ্যে যে তিনটি ভূমিকম্প দেশকে নাড়া দিয়েছে, এর একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে এবং এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ২। অন্য একটি মৃদুমাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা। গেল আগস্টে দেশে অনুভূত দুই দফার ভূমিকম্পের মাঝারি ধরনের একটির উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। বারবার মৃদু বা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প আগামীতে একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের লক্ষণ হতে পারে- এমন অভিমত অনেক বিশেষজ্ঞের। আর বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরিণতি যে কত ভয়াহত হতে পারে তার প্রমাণ সম্প্রতি মরক্কোর ভূমিকম্প। গেল ৮ সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১১ মিনিটে মরক্কোতে ঘটে যাওয়া রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। মরক্কোর ভূমিকম্পের পরের দিন বাংলাদেশেও মৃদু ভূমিকম্প দেখা দেয়। ওইদিন সিলেটে অনুভূত ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম। ২০০৩ সাল থেকে ভূমিকম্প নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের মতে, ভূতাত্ত্বিক ও টেকনোটিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। একটা ইন্ডিয়া প্লেট এবং এর পূর্বে বার্মা প্লেট এবং উত্তরে এশিয়া প্লেট। ইন্ডিয়া এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। বলা হয়, প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হওয়ার ফলে এই অংশে যে শক্তি জমা রয়েছে, সেটা একসঙ্গে বের হলে ৮ দশমিক ২ স্কেলের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শক্তি একবারে বের না হয়ে আংশিক বের হলে ভূমিকম্পের মাত্রা কম হবে। গত ২০০ বছরে বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১, যা সর্বোচ্চ ১০ মাত্রায় পৌঁছে। এ ভূমিকম্পে ব্যাপক সম্পদহানি ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে ১ হাজার ৫৪২ জন মানুষ। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ মাত্রার ১১৫টি এবং ৫ মাত্রার ১০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্টে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে মাত্র ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের চাউক অঞ্চল।

বাংলাদেশের নগর স্থাপনা নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়মের কারণে মাত্র রিখটার স্কেলের সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, বিগত দিনে এমন আশঙ্কা জানানো হয়েছে ভূতত্ত্ব জরিপের ফলাফলে। রাতের বেলায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৯০ হাজার এবং দিনের বেলায় হলে ৭০ হাজার রাজধানীবাসী হতাহত হতে পারে। ঢাকা সিটি করপোরেশন অঞ্চলের ৭ লাখ ২৬ হাজার ভবনের ওপর সমীক্ষা চালানোর পর এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ত্রিদেশীয় অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন, বৈশিষ্ট্য অনুসারে এর অবস্থানকে পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে ধরা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়ার মতো প্লট বাউন্ডারি বা ফাটলরেখা সক্রিয় রয়েছে, যার ফলে যেকোনো সময়ে দেশে ৮ থেকে ৯ মাত্রারও ভূমিকম্প হতে পারে। রাজধানী ঢাকার মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার মতো ভূতাত্ত্বিক ফাটল রয়েছে। এ ফাটল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অস্থির ভূ-স্তরের ওপর অবস্থান করায় এখানে ভূমিকম্পজনিত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ইন্দো-বার্মা-হিমালয়ান, ইউরেশীয় একাধিক ভূ-স্তর ফাটলের লাইন বিস্তৃত থাকায় এবং এর সঞ্চালনের ফলে বাংলাদেশ এবং এর আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প বলয়টি বিশ্বের অন্যতম ক্রিয়াশীল বলে বিবেচিত। এসব অঞ্চলের বারবার মৃদু, মাঝারি এবং কখনো এরও অধিক মাত্রার কম্পনের কারণে ভূ-ফাটলরেখাগুলো ক্রমেই শিথিল ও নাজুক রূপ নিয়েছে, যা আগামীতে শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, মাটির নিচে ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেট একে অন্যের দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং কোনো সময় এই দুটি প্লেটের একটি অন্যের ওপর পিছলে গেলে প্রচুর শক্তি খরচ হয়, যার ফলে দেখা দেয় ভূমিকম্প। আর এই শক্তি যত বেশি প্রবল হবে, ভূকম্পনের মাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা ৩টি প্লেট বাউন্ডারির সংযোগস্থলে থাকার ফলে সেসব অঞ্চল বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। তা ছাড়া বাংলাদেশের ছয়টি স্থানের মাটির নিচে বড় ধরনের ফাটল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ফাটলটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার লম্বা। এসব ফাটলের কারণে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, রংপুর এবং দিনাজপুর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভবনধসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার সন্তোষজনক ব্যবস্থা বাংলাদেশে অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা জনবহুল ঢাকা মহানগরীর সরু রাস্তাঘাট, অলিগলি পেরিয়ে ভবনধস-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভবপর নয়। ভবনধসের পর স্বাভাবিক ক্রমে বিধ্বস্ত হয়ে যায় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো জরুরি ব্যবস্থাগুলো। এসব দ্রুত পুনঃস্থাপনের সামর্থ্য বা প্রস্তুতি কোনোটাই তেমন নেই বাংলাদেশে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ভবনধস-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো হয়ে পড়বে কষ্টকর।

বাংলাদেশে অনুভূত ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে আঘাত হানা স্মরণকালের শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে নেপালের রাজধানী কাটমান্ডুর মাত্র ৮১ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে লামজংয়ের ২৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পোখরা কেন্দ্রে ভূ-পৃষ্ঠের মাত্র ২ কিলোমিটার গভীরে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ধারারা টাওয়ারের মধ্যেই জীবন হারান ১৮০ জন মানুষ। রাজধানী কাটমান্ডুতেই ৭০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণনাশ ঘটে। তুরস্কের অন্যতম শহর ও প্রাদেশিক রাজধানী গাজিয়ানতেপ থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে রিখটার স্কেলের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে ৩ হাজারের বেশি ভবন ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তুরস্ক ও সিরিয়া দুদেশ মিলিয়ে ৪৫ হাজারের বেশি প্রাণহানির খবর মেলে। বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে, ভূমিকম্পটি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিমে ভূগর্ভে অবস্থিত পূর্ব আনাতোলিয়ান প্লেটের আশপাশে ঘটেছে। তুরস্কের ইতিহাসে কয়েকটি ভযাবহ ভূমিকম্পের জন্য দায়ী এই আনাতোলিয়া ফল্ট। বিশেষ করে ১৮৮২ সালের ১৩ আগস্ট ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় তুরস্ক। এরপর ১৯ শতকে ওই এলাকার ভূমিকম্পে সিরিয়ার আলেপ্পোয় ৭ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের মধ্যে হাইতিতে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি চিলিতে ৩ মিনিট স্থায়ী রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫২৫ জন নিহত এবং নিখোঁজ হয় ২৫ জন। হাইতির ভূমিকম্পের তুলনায় চিলিতে আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা অনেক বেশি হলেও চিলিতে মানুষের মৃত্যু এবং জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণে চিলিতে এত বড় শক্তিশালী ভূকম্পনের পরও বিদ্যুৎ, টেলিফোন, টেলিভিশন সংযোগ অব্যাহত থাকে। চিলিতে প্রাণহানিও কম হয়েছে, সেখানে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের কারণে। ১৯৭৩ সাল থেকে কমপক্ষে ১৩টি ছোট-বড় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চিলিতে ভূমিকম্প মোকাবিলায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক জনসচেতনতা। এমনকি স্কুল, কলেজেও ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ২০২১-২৫ সালের বাংলাদেশ জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় বলা হয়, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে ১১ লাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা ভবন, ৪০২টি খাদ্যগুদাম, ১৪টি গ্যাসফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল, ১ হাজার ৮টি কল্যাণ কেন্দ্র, ২ হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, ১ হাজার ৯০০ মাদরাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬ হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ এবং ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভূমিকম্প সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অতি পুরোনো জীর্ণশীর্ণ ভবনগুলোকে ভেঙে ফেলা দরকার। যেসব ভবনকে মোটামুটি বাসযোগ্য মনে হয়, সেগুলোকে রিট্রোফিটিং করে কিছুদিনের জন্য টিকিয়ে রাখা গেলে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রাণহানির সংখ্যা হ্রাস করা যাবে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রোডম্যাপ তৈরি করে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ভূমিকম্প-পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক পরিবেশ ও মাটির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে সতর্কতার সঙ্গে ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ না করা হলে ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয় মোকাবিলা কঠিন হযে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close