মো. সাখাওয়াত হোসেন
দৃষ্টিপাত
আগামীর সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সমগ্র বাংলাদেশে নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রদানও শেষ করেছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বিভিন্ন জোটে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কোনো কোনো দল আবার এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রদান সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য দলও দলীয় প্রার্থী নির্ধারণ করেছে নির্বাচনে অংশগ্রহনের লক্ষ্যে। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তে এখনো অনড় বিএনপি। কিন্তু বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত অনেক প্রাক্তন এমপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিমিত্তে এককভাবে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির অনেকেই মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। কাজেই দেশ একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, একটি জমজমাট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশায় দেশবাসী। নির্বাচন কমিশনও প্রার্থীদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে আশ্বস্ত করেছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকও নির্বাচনে উপস্থিত থেকে নির্বাচনকে প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর করার ব্যাপারে সহযোগিতা করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন সেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে তেমন সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এখন সাধারণ মানুষের প্রার্থীদের কাছে প্রত্যাশা রয়েছে এবং সুনির্দিষ্ট ইশতেহার প্রদান সাপেক্ষেই জনতার ভোট পদপ্রার্থীদের ভোট বাক্সে যাবে। তবে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন বাংলাদেশের উন্নতির যে ধারা বিদ্যমান সেটি যেন চলমান থাকে সে ব্যাপারে সবাই প্রত্যাশা করবে। পৃথিবীর বুকে মর্যাদার প্রশ্নে বাংলাদেশের যে সুস্থির অবস্থান সে জায়গা থেকে ক্রমান্বয়ে কীভাবে আরো উন্নতি করা যায় সে বিষয়েও জনতার আগ্রহ থাকবে। প্রকৃত অর্থে ভোটারদের প্রত্যাশা হবে ঊর্ধ্বমুখী। যেসব সূচকে বিশেষ করে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নতি করেছে সেসবের ধারা আরো উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। সত্যিকার অর্থে জনতার দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে আসন্ন সরকারকে আরো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। কেননা গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের আমূল পরিস্থিতিকে যেভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে সেই ধারাবাহিকতা থেকে পেছনে ফেরত আসার কোনো সুযোগ নেই। নতুন সরকারে যারাই আসুক তাদের বিগত ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা সামনে রেখেই অগ্রসর হতে হবে।
যেহেতু জাতীয় নির্বাচন সংগত কারণেই বিভিন্ন শ্রেণিপেশা মানুষের আগত সরকারের কাছে ভিন্নরূপ প্রত্যাশা থাকতে পারে। বিশেষ করে যারা চাকরিপ্রত্যাশী তাদের এক ধরনের এজেন্ডা থাকে, আবার যারা পরিণত বয়সে অবস্থান করছেন তাদের ভিন্ন ধরনের চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে সরকারের কাছে এবং এটাই স্বাভাবিক। সব দিক বিবেচনায় নিয়েই সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হয়, দায়িত্ব পালনে সরব থাকতে হয়। সরকারি চাকরি নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই অবগত হয়েছেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ কর্মকমিশনের সার্কুলার নিয়মিত হচ্ছে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াও যথাসময়ে সম্পন্ন হচ্ছে। নতুন সরকারে যারাই আসুক তাদের এরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে পিএসসি থেকে প্রদত্ত সার্কুলারে গরিমসি লক্ষ করা যায়, কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিষয়টির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছতা এসেছে সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নতুন রাজনৈতিক সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
আবার যারা পড়ন্ত বয়সে সমাসীন, শারীরিকভাবে অসুস্থ ও দুস্থ তাদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক কর্মকাণ্ড ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সরকার অসংখ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। অসহায় ও গৃহহীনদের বাড়ির পাশাপাশি জমির মালিকানাও নিশ্চিত হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি কার্ডসহ অসংখ্য সেবামূলক উদ্যোগের ভিত্তিতে সরকার সাধারণ মানুষের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করেছে। নতুন সরকারকেও এ ধরনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি তৃণমূলে সরকারি সেবা নিশ্চিতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। সে চ্যালেঞ্জও নতুন সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সহনীয় রাখতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সফলতা পেয়েছে। বিশেষ করে সরকারিভাবে আইনগত সহায়তা প্রদান, ৯৯৯ সার্ভিস, অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ, বিট পুলিশিং কার্যক্রম গ্রহণ, ট্যুরিস্ট পুলিশের সম্প্রসারণ, কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে প্রায়োগিকভাবে শক্তিশালীকরণ, বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে নিরাপদ রাখতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সব মিলিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে শাস্তির মাধ্যমে ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারও সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। তা ছাড়া উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন বাহিনীকে শক্তিশালীকরণের আওতায় সরকারের নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ জনমনে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে। বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে আরো মজবুত করেছে। সুতরাং এ জায়গাগুলোতেও নতুন সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা থাকবে নিঃসন্দেহে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে ধারাবাহিকতা এক দশক ধরে বাংলাদেশে চলমান সেটিকে ধরে রাখা নতুন সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হবে। আইএমএফ বলেন কিংবা বিশ্বব্যাংক বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির অনেক সূচকেই ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। এ জায়গা থেকে পেছনের দিকে কখনো আসতে চাইবে না বাংলাদেশ। সে কারণেই নতুন সরকারে অর্থনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি উন্নতির ধাপে আরো অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে সাধারণ জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানির দিকে চলে আসবে। অন্যান্য সেক্টরে বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকরণ, যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও সম্প্রসারণ, কৃষিতে বিপ্লব, সামাজিক বনায়ন, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ, মেডিকেল কলেজ নির্মাণ, মেডিকেলে রোগীদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা (শুধু স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে একক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়), সর্বত্র ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি; সব দিক বিবেচনায় নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশাকে আরো বেগবান করবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রের পবিত্র রক্ষাকবচ সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিগত সরকারের যে দায়িত্বশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে, সেটির ধারাবাহিকতাও প্রত্যাশা করে এ দেশের জনগণ।
সবশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করা চলে সেটি হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে সরকারের অভাবনীয় সফলতা দেশবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে দেশের ইমেজ বৃদ্ধি করেছে। এ রকম অসংখ্য অর্জনের কারণেই বাংলাদেশের মর্যাদা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে বিশেষ মর্যাদায় পর্যবসিত করেছে। সুতরাং এ রকম আরো উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে আগামীতেও বাংলাদেশ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সুপরিচিত পাবে এবং দেশ ও দশের মর্যাদাকে অধিকতর উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করবে- এমনটাই প্রত্যাশা বাংলাদেশের আপামর জনতার।
লেখক : চেয়ারম্যান
ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"