ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

বিশ্লেষণ

গৌরবের যা কিছু অর্জন

সামনে বৈশ্বিক যে সংকট আসছে, এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোও উদ্বিগ্ন। আমরা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অনেকটাই স্পর্শ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার উদাত্ত আহ্বানে ন্যূনতম কোনো ভূমি অনাবাদি না রেখে প্রতি ইঞ্চি জমির উর্বরতার যথার্থ ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া আগামী দিনের সম্ভাব্য খাদ্যসংকট উত্তরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ সময়কালে বাংলাদেশের অফুরান অর্জন, যা ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সদর্পে এগিয়ে চলছে ইউএনডিপির টেকসই লক্ষ্যমাত্রায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ৭৫-পরবর্তী সময়ে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবারও উন্নতির শিখরে উঠতে শুরু করে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায়, দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

গত ১৩ বছরে দেশের প্রতিটি খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মর্যাদাশীল উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল অর্জন। বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রায় বিশ্বের বিস্ময়।

দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি বর্তমান সরকারের অদম্য সাফল্য। গত এক দশকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন, এমনকি মহামারির সময়ও এ দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। আমরা এখন উন্নয়ন মহাযজ্ঞের সুবিশাল যাত্রা অতিক্রমের মহাসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সূচকের তার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলার। এ দেশের গড় জিডিপি ৭ শতাংশ প্রায়। শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ এবং শিশু শিক্ষার হার প্রায় ৯৯ শতাংশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যার হার প্রায় শতভাগ। ১২১টি মেগা প্রকল্প এখন চলমান। জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। আগামী ২০২৫ সালে তার আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।

অনেক অবধারিত উন্নয়ন শোভাবর্ধন করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। লিঙ্গসমতা, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুন্দ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণে।

শত বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দেশ আজ অনন্য স্থানে অধিষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের দিন-বদল হয়েছে। তিনিই বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন ‘রূপকল্প ২০২১’। গত দশকে দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা দুর্বার গতিতে শুরু হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ, ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ- এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ও অবিচল নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে উন্নয়ন কৌশল ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ফলে। রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে রূপকল্প-২০৪১।

গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে জাতি এক পরম আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লড়াকু জীবন একসূত্রে গাঁথা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য বলতে ভরসা ছিল শুধু পাট, অন্যটি চামড়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। রপ্তানিতে পাট ও পাটপণ্যের অবদান ছিল ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে পোশাকশিল্প খাত থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ডলার।

বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে। ব্যবসাবান্ধব বর্তমান সরকার গার্মেন্ট সেক্টরে অনেক প্রণোদনা দিয়ে আসছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে এ শিল্প। আমাদের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক খাত হচ্ছে প্রবাসীদের অর্জিত আয়। প্রতিদিন, প্রতি মাসে, প্রতি বছরে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। আর ২০২১-২২ সালে আমাদের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যবিমোচনে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে তা দাঁড়ায় ২০ শতাংশ।

৫২ বছরে এসে জাতীয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালের জাতীয় বাজেট হচ্ছে ৬ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। বৃহৎ এই বাজেট দেশের উন্নয়নে কাজে আসবে। উন্নয়নের ধারায় বাজেটের এই বৃদ্ধি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমাদের জিডিপি ২ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনা মহামারিকালেও আমাদের ২০২০-২১ সালে জিডিপি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আমাদের রাজস্ব আয় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৩ সালে রাজস্ব আয় হয় ১৬৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আমাদের রাজস্ব অর্জিত হয় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অর্জন। রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৫৬৬ গুণ।

গত ৫২ বছরে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। খাদ্যশস্য ১৯৭২ সালে উৎপাদিত হয় ১ দশমিক ২০ কোটি টন। আর ২০২০ সালে উৎপাদিত হয় ৪ দশমিক ২৫ কোটি টন। সবজি উৎপাদনে আমরা পৃথিবীর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছি। সবজি উৎপাদনে পৃথিবীতে প্রথম চীন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। বর্তমানে আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশ সবজি রপ্তানি করছি। পাট উৎপাদনে এখন আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। দেশে এখন নানা রকম পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে, রপ্তানিও হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বিশ্বে ছিল অনুকরণীয়। শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়ে। বাংলাদেশের শিশুরা জন্ম নেওয়ার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ বেঁচে থাকে। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আমাদের গড় আয়ু বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২৩ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ দশমিক ৬ বছর।

শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত হয়েছে নানা পদক্ষেপ। শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিনা মূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম, নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি ব্যবস্থা প্রশংসার দাবি রাখে। বর্তমান সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে প্রায় শত ভাগে।

সারা দেশ এখন উন্নয়নের বহুমাত্রিক কর্মপ্রকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের তৃণমূলপর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০। দেশের সব উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।

সামনে বৈশ্বিক যে সংকট আসছে, এ নিয়ে উন্নত দেশগুলোও উদ্বিগ্ন। আমরা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অনেকটাই স্পর্শ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তার উদাত্ত আহ্বানে ন্যূনতম কোনো ভূমি অনাবাদি না রেখে প্রতি ইঞ্চি জমির উর্বরতার যথার্থ ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া আগামী দিনের সম্ভাব্য খাদ্য সংকট উত্তরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার সিংহভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে।

আমাদের গর্ব ও গৌরবের এই ধারা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নতসমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্যোর্তিময় অভিযাত্রা যেন কালো অধ্যায়কে আলোক ঝরনাধারায় উদ্ভাসিত করে দিল। এক অদম্য গতিতে অশুভ সংকেতের বাধা-বিপত্তিকে উপড়ে ফেলে অপ্রতিহত গতিতে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে চলছে।

লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close