তানজিব রহমান

  ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

অপরাহ্ণের রাজনীতি

প্লেন ল্যান্ড করেছে। যাত্রীরা সবাই নেমে গেছে। পাইলট হোটেলে পৌঁছেছেন। উড়োজাহাজে বিশ্রামরত রাজপুত্র ঘুম থেকে উঠে দেখেন প্লেনে কেউ নেই। বেশ আগ্রহ নিয়ে তিনি পাইলটের ককপিটে আসেন। দেখেন সেখানে একটা বই। শিরোনাম- কীভাবে পাইলট হতে হয় (প্রথম খণ্ড) উৎফুল্ল রাজপুত্রের চোখ ছানাবড়া! বিমানের পাইলট হতে আর কিছু সময় বাকি তার! আগ্রহ নিয়ে বইয়ের প্রথম পাতা ওলটালেন। সেখানে লেখা লাল বোতামে চাপুন, প্লেনের ইঞ্জিন চালু হবে। তিনি তাই করলেন। লাল বোতামে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। পরের পাতায় লেখা- উড়োজাহাজকে সামনে অগ্রসর করাতে চাইলে এবার এই নীল বোতামটি চাপুন। তিনি আর অপেক্ষা না করে তাই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উড়োজাহাজ সামনে এগোতে লাগল। পরের পাতায় লেখা গ্রাউন্ড থেকে শূন্যে ওড়াতে চাইলে এবার সবুজ বোতাম চাপুন, এতে কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে আপনার যোগাযোগও বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। সাত-পাঁচ না ভেবে রাজপুত্র সবুজ বাটন চাপলেন, রাজপুত্র তো অবাক! প্লেন শূন্যে ওড়া শুরু করেছে এবং ওপরে উড়ছে তো উড়ছেই। তার আনন্দের সীমা নেই। এত সহজেই প্লেন আকাশে ওড়ানো যায়। প্রায় বিশ মিনিট তিনি আকাশে উড়লেন। এবার নামার পালা। বইয়ের পরের পাতা ওলটালেন। সেখানে লেখা প্লেন কীভাবে নিচে ল্যান্ড করাতে হয়, সেটা শেখতে চাইলে আমাদের পল্টন শাখা থেকে বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটি কিনুন এবং আমাদের ফ্লাইট লার্নিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যান! রাজপুত্র পড়লেন মহাবিপদে, তিনি আর কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে অনিয়ম করে তিনি হয়ে গেলেন প্রিন্স থেকে ডার্ক প্রিন্স। প্লেন ল্যান্ড করাতেও পারছেন না, পল্টনেও যেতে পারছেন না। তার পরও তিনি পাইলটের আসন ছাড়তে রাজি নন কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে একসময় বেলা শেষ হয়ে এলো অপরাহ্ণ। মোরাল অব দ্য স্টোরি হচ্ছে অল্প বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে নিজেকে পাইলট ভাবা যায় কিন্তু সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। সেটা বিমানে কিংবা রাজনীতিতে যেখানেই হোক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ভিত্তি জাতীয় স্মৃতিসৌধের সাতটি স্তম্ভ নির্দেশক হিসেবে আমাদের কাছে গৌরবদ্বীপ্ত অতীতের স্মারক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছাপ্পান্নর শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘ এ পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশের নেতৃত্বদান করেছেন তা যেমন সত্য, আবার স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতাকারী অ্যান্টি আওয়ামী লীগ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা একটি বিশাল অংশও বাংলাদেশে রাজনীতির ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছে কিন্তু রাজনীতির জনভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতির যে গণভিত্তি নেই, তা আমরা দেখেছিলাম ১০ ডিসেম্বর ২০২২ ও সবশেষ ২৮ অক্টোবর ২০২৩-এর অপরাহ্ণে। মহাসমাবেশ করে গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলে যারা মিয়ান আরেফ নাটক মঞ্চস্থ করে, তারা যে জনগণকে ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না, তা এখন প্রমাণিত।

যারা গণ-আন্দোলনের কথা বলে এখন ভিডিও বার্তা দিয়ে নিজেদের দায় সারতে চান। হরতাল-অবরোধের চেনাজানা কর্মসূচি দিয়ে অতীতের মতো ঘুমটা পরা নেতা হতে চান, তারা জানেন না রাজনীতিতে কীভাবে ল্যান্ডিং করতে হয়, কীভাবে টেক অব করতে হয়। জনগণের ডানায় ভর করার শক্তি-সাহস হারিয়ে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে মিথ্যা তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায় কিন্তু গণভিত্তি রচনা করা যায় না। যার পরিণতিতে বিএনপির অনেক প্রবীণ নেতা ডার্ক প্রিন্সের রাজনীতি থেকে বের হয়ে নিজেরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপির প্রবীণ নেতা মেজর আখতার সম্প্রতি একটি টিভি টকশোতে বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির পরাজয় ২৮ তারিখ নিশ্চিত হয়ে গেছে। লন্ডনে আবদ্ধ ঘরে বসে কফির পেয়ালা চুমুক দিয়ে সরকার পতন হয় না। তারেক রহমানের নিজের ভুলের খেসারত দিচ্ছে বর্তমান বিএনপি। গ্রেনেড হামলাসহ প্রতিহিংসার রাজনীতির পথ তৈরি করে তারেক রহমান যে ভুল করেছেন তার কারণেই বিএনপি আজকে পথহারা পথিক, বিশাল সাগরে হাল ভাঙা একটি নৌকা, যার কোনো মাঝি নেই। বিএনপির গঠনতন্ত্রের কোথাও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের কোনো পদ নেই, কিন্তু তারেক রহমান নিজেই সে পদ সৃষ্টি করে আসন গেড়ে আছেন।

অতীতে তারেক রহমান মনোনয়ন-বাণিজ্যের জন্য সমালোচিত হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপির প্রবীণ রাজনীতিবিদরা মোটেও খুশি নন। যার ফলে খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টাসহ অনেকেই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র কিনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। কেননা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক নেতাই প্রবীণ, যারা পরবর্তী পাঁচ বছর পর আবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলে মনে করেন না। একজন রাজনীতিবিদ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধিত্ব করার জন্য। তারেক রহমানের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে নির্বাচনের আগমুহূর্তে অনেক নেতাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিএনপি থেকে। তারা মনে করেন- ‘আকাশে চাঁদ উঠলে কেউ খুশি হয় চাঁদ দেখে; আবার কেউ অখুশি হয় চাঁদ না উঠলে তো আমি চুরি করতে পারতাম’ এই ভেবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা খুশি হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। আবার অনেকেই অখুশি কিছু অদৃশ্য কারণে, যার অনুসন্ধানে না হয় আপাতত নাই গেলাম।

তবে হাওয়া ভবন থেকে রাজনীতির ককপিটে বসার যে স্বপ্ন তারেক রহমানকে হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখেছে, তা থেকে উদ্ধারের মন্ত্র বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড বোধহয় আর সহজসাধ্য নয়। কারণ এরই মধ্যে তিনি ডার্ক প্রিন্স হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন। আইন এবং আদালতের চোখে তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। রাজনীতির নেতৃত্ব তিনি কাউকে দিচ্ছেনও না আবার নেতাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও এখন হুমকির মুখে। একজন ডার্ক প্রিন্সের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত হয়তো বিএনপির রাজনীতিকে অপরাহ্ণের দিকে ডাকছে, যা সম্প্রতি সজীব ওয়াজেদ জয় তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ১০-১৫ বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত বলে কিছু থাকবে না।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close