আরিফুল কাদের
মুক্তমত
বয়কট নয়, বিকল্প তৈরি করুন
বলা হয়ে থাকে জাতি হিসেবে আমরা অনেক আবেগপ্রবণ। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেকের চেয়ে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমরা খুবই স্পর্শকাতর মানুষ। যেকোনো বিষয়ে নিজেদের বিশ্বাস ও অন্তরে ধারণ করা মূল্যবোধে আঘাত এলে আমরা সহ্য করতে পারি না। ধর্মীয় আঘাত কিংবা জাতিগত আঘাত, যেকোনো আঘাত এলে কিংবা তার আশঙ্কা থাকলে আমরা বয়কট বয়কট খেলায় মেতে উঠি। কিন্তু আমরা কেন বয়কট খেলায় মেতে উঠব? সে বিষয়গুলো আমরা কখনো ভেবে দেখি না। কেন বয়কট করছি? এর কারণ কী? ফলাফল কী? বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কখনো ভাবি না। কিছু হলেই শুধু বয়কট বয়কট করি।
নিজেরা কখনো ভেবেও দেখি না এই বয়কট আদৌ কোনো কাজে আসে কি না। বয়কটের উদ্দেশ্য কী? বয়কটের অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। এগুলোর অন্যতম কারণ হলো- ওই কোম্পানির বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিকভাবে ক্ষতি করা, ওই প্রতিষ্ঠান দ্বারা কোনো ধরনের অনৈতিক কর্ম না ঘটা অথবা ওই প্রতিষ্ঠান যাতে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজে সমর্থন করতে না পারে। কথায় আছে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?’ আমাদের দৈনন্দিন জীবন অনেকাংশে তাদের ওপর নির্ভরশীল, যাদের আমরা বয়কটের চিন্তা করি। কিন্তু আমরা যা বয়কট করতে চাচ্ছি তা তো আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মানুষের প্রধান মৌলিক অধিকার পাঁচটি। যথা : খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আমরা আমাদের মৌলিক অধিকার পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। কোনো না কোনোভাবে আমাদের বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমান বিশ্ববাজারে খাদ্য, চিকিৎসা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের অনেক কিছু পশ্চিমাদের হাতে। আমরা শুধু খাদ্য, বস্ত্র কিংবা চিকিৎসায় পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীল এমন কিন্তু নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় বহু পণ্য পশ্চিমাদের হাতে। তাদের একেকটি কোম্পানি বহুজাতিক পণ্য বাজারে নিয়ে আসে। আমরা কোনো কারণে তাদের একটি পণ্য বয়কট করলেও অন্যটি আঁকড়ে ধরতে হবে। আগেই বলেছি তাদের বিভিন্ন ঘরানার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমরা একটি বয়কট করলেও তা ধরে রাখতে পারব না। কেননা অন্য ক্ষেত্রে আমাদের আবার তাদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কোনো কারণে তাদের একটি পণ্য যদি আমরা বয়কট করি তাহলে তারা আমাদের নিকট রপ্তানি করাই বন্ধ করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি। এমনকি অর্থনৈতিক মন্দাও দেখা দিতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে কিন্তু তারাই মোড়ল। তারা আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ক্ষমতা রাখে। কোনো কারণে তারা নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে যদি আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তাহলে আমরা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীনও হতে পারি। কেননা আমরা এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই তাদের বয়কট করার চিন্তা করা মানে খাল কেটে কুমির আনা। আজকে তাদের বয়কট করতে গেলে তারা আর্থিকভাবে ১ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমরা হব ৪৯ শতাংশ। আজকে বয়কট করে আগামীকাল আবার তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই বয়কটের পরিবর্তে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আমাদের আর তাদের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে আমরা নিজেরাই নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারি। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে আমাদের আর কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়।
এই পরিবেশ একমাত্র তৈরি হবে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে। বিকল্প ব্যবস্থার জন্য আমাদের আগে দেখতে হবে আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ওপর নির্ভরশীল। আমরা চিকিৎসা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য আমদানি-রপ্তানি উভয় দিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল। উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা তাদের দেশে যাই। আবার বিভিন্ন মৌসুমে নানা পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। কাজেই আগে আমাদের এই নির্ভরতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে আমাদের অবশ্যই তাদের পণ্যের বিকল্প তৈরি করতে হবে। পণ্যের বিকল্প থাকলে তাদের বয়কট আমাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু তা তাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আমরা যদি একটু পিছিয়ে উসমানীয় শাসনামলে ফিরে যাই তাহলে আমরা তার বাস্তবায়ন দেখতে পাব। উসমানীয় শাসনামলে যখন বাজার দর অস্থির হয়ে যেত, তখন উসমানীয় শাসকরা কোনো পণ্য বয়কট করতেন না, বরং তার বিকল্প তৈরি করতেন। যখন জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হতো তখন উসমানীয়রা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ওইসব পণ্যের বিকল্প তৈরি করে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। ফলে রাতারাতি ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হতেন। হাতে বিকল্প থাকলে কোন পরিস্থিতি পর্যন্ত যাওয়া যায় তা আমরা আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এই যুদ্ধে পশ্চিমাগোষ্ঠী রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সামরিক নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করেও তাদের টনক নড়াতে পারছে না। কারণ আজকের রাশিয়া অনেক পরিপূর্ণ। প্রতিটি সেক্টরে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। অতএব আমরা যতক্ষণ বিকল্প তৈরি করতে পারব না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বয়কট কোনো কাজে আসবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
"