ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস

প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়

আজ রবিবার আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০২৩। বিশ্বজুড়ে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সুরক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উদযাপন হতে যাচ্ছে ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। দেশে এ বছর ২৫তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন হবে। এ বছর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’। বিশ্বে প্রায় চার বছর ধরে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ মানব জীবনে যেসব নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে স্বভাবতই প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকেও তা প্রভাবিত করেছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নারী, পুরুষ, হিজড়াসহ বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা দেশে এখন সরকারের নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী অর্থাৎ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ। বর্তমানে তাদের মধ্যে ২৩ লাখ ৮৫০ টাকা করে ভাতা পান। নতুন বাজেটে ভাতা বাড়ানো হয়নি। তবে উপকারভোগী বাড়িয়ে ২৯ লাখকে ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবছর আমরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে থাকি। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকারের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা মূল্যয়নের সময় এসেছে। অথচ অন্যসব সাধারণ নাগরিকের মতো তাদেরও রয়েছে সমান সুযোগের অধিকার।

প্রতিবন্ধী শব্দটি যেন এক বৈষম্যের প্রতিধ্বনি। শব্দের অন্তর্গত অর্থ সেই শব্দের নাম নির্দেশ করে থাকে। সেজন্য অন্য শব্দ ব্যবহৃত হলেও হয়তো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেই শব্দকেও নেতিবাচক করে তুলবে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈষম্যের উৎপত্তি এবং বৈষম্য থেকে জনবিচ্ছিন্নকরণ। প্রতিবন্ধী নাগরিকরা যেন সমাজে অন্যসব নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেন, সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। আর শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই দিবসটির সূচনা হয়। সমাজের অবিচ্ছেদ্য এ অংশকে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।

প্রতিবন্ধী মানুষের রয়েছে নানা রকম প্রকারভেদ। শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাকপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, এমনকি বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী এই মানুষগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জীবনযুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে জীবনকে পরিচালনা করছে। দুঃখজনক হলেও এটাই চূড়ান্ত বাস্তবতা যে, প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে রয়েছে পদে পদে বাধা। এরা পৃথিবীর রং, রূপ ও রসের বিলাস-বৈচিত্র্যের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় সুন্দর এই জীবনটাকে যথাযথভাবে উপভোগে বরাবরই অক্ষম। দিকে দিকে যে বিচিত্র কর্মধারা নিত্যপ্রবাহিত, সেখানে যোগদানের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিনিয়ত অবহেলিত ও নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতার শিকার। ফলে ধীরে ধীরে এদের জীবনে আসে হতাশা। অদৃশ্য শিকলে হাতদুটো যেন বাঁধা পড়ে যায় অজান্তেই। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সর্বদিক ।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার তিনটি লক্ষণ- প্রথমত, এদের বুদ্ধি তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কম থাকে। ওয়েক্সলার ইন্টেলিজেন্স স্কেল অনুযায়ী এদের আইকিউ ৭০ বা তার কম থাকে। দ্বিতীয়ত, জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতার ক্ষেত্রে এ শিশুদের যথেষ্ট ঘাটতি থাকে। তৃতীয়ত, ব্যক্তির মানসিক প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি তার ১৮ বছর বয়সের আগেই দৃশ্যমান হয়। বেশির ভাগ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রথম দর্শনে বোঝা যায় না যে, তাদের কোনো সমস্যা আছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের বিকাশ একটু দেরিতে হয়। তারা দেরিতে কথা বলতে শিখে, তাদের স্মৃতিশক্তি কম থাকে, মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা ও ধৈর্য কম থাকে, কোনো কিছু শিখার ক্ষমতাও কম থাকে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ এ দেশের সব নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই, দেশের প্রতিবন্ধী জনগণের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনগণ, সংশ্লিষ্ট সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাই বলি, একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে কেবল প্রতিবন্ধী হিসেবে অনুগ্রহ নয়, দিতে হবে মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান। প্রতিবন্ধীদের যদি মানুষ হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান ও সমণ্ডঅধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তারা দেশ ও জাতির জন্য বয়ে আনতে পারে অকল্পনীয় সম্ভাবনাময় অর্জন। তাদের অনেকের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অসাধারণ প্রতিভা। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। অথচ সময়মতো চিকিৎসা পেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা ভালো হয়ে যায় আর সম্পূর্ণ ভালো না হলেও সমাজে উপার্জনক্ষম হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ধরন অনুযায়ী মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো, অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক, মানসিক অসুস্থতাজনিত, দৃষ্টি, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি, এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।

এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার কারণ জানা যায় না। বিভিন্ন রোগের প্রভাবে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা হতে পারে। ডাউন্স সিনড্রোম, ভেলোকেরিওফেসিয়াল সিন্ড্রোম এবং ফেটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম জন্মগত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। কখনো কখনো বাবা-মার থেকে প্রাপ্ত অস্বাভাবিক জিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার কারণ হিসেবে কাজ করে। গর্ভাবস্থার সমস্যার জন্য বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা হতে পারে। আবার জন্মকালীন সমস্যার কারণেও বুদ্ধিপ্রতবন্ধিতা হতে পারে। কিছু রোগ ও বিষাক্ততার প্রভাবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা হতে পারে। যেমন- হুপিং কাশি, মিজলস, মেনিনজাইটিস রোগের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা হতে পারে। সিসা বা লিড, মারকারি ইত্যাদি বিষাক্ততার শিকার হয়েও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা হতে পারে। আয়োডিনের ঘাটতির কারণে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হতে

পারে। অপুষ্টির কারণেও এটি হতে পারে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার জন্য যেসব রোগ ও সংক্রমণ দায়ী সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা বিশেষভাবে দরকার।

শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে কি না- তা খেয়াল করা বাবা-মায়ের জরুরি দায়িত্ব। যেসব শিশুর প্রতিবন্ধী হয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, তা আগে থেকেই বোঝা গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। সাধারণত অভিভাবকরা এ ধরনের সমস্যা বুঝতে অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেন। ১. শিশুর বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্ত মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতে হবে। স্বাভাবিক বিকাশের ধীর গতি প্রতিবন্ধী শিশুর সবচেয়ে বড় লক্ষণ। তাই শিশুর আবেগ, সামাজিক এবং অন্যান্য সাধারণ জ্ঞানবিষয়ক কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করুন। বয়স অনুযায়ী তার মানসিক বিকাশ হচ্ছে না বলে মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ২. অনেকেই শিশুর মধ্যে ধীর মানসিক বিকাশ লক্ষ করার পরও ভাবেন হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আরো কিছুদিন অপেক্ষার পক্ষপাতী তারা। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এমন লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিলে শিশুকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসকের কাছে নেওয়া উচিত। ৩. প্রত্যেক শিশুর সামান্যতম সমস্যা হলে তার বাবা-মা সবার আগে বুঝতে পারেন। তাই শিশুর আচরণ ও মানসিক বিকাশ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

হোমিও প্রতিকার : প্রতিবন্ধী শিশুদের বাবা-মার প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন কালবিলম্ব না করে তাদের সন্তানকে কোনো হোমিও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাধীনে ন্যস্ত করেন, হোমিওপ্যাথি হলো একটি জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি, এই পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং সম্পূর্ণ উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়, সব লক্ষণ এবং উপসর্গ মুছে ফেলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের ফিরে যাওয়ার একমাত্র উপায় এটি হোমিওপ্যাথির উদ্দেশ্য প্রতিবন্ধী রোগীর অন্তর্নিহিত কারণ এবং ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা মোকাবিলার মাধ্যমে আরোগ্য করা, রোগের কারণ অনুভূতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং হ্রাস বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়, আর সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথিতে প্রতিবন্ধী রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।

আসুন সরকারের পাশাপাশি আমরা সবাই প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিই। তাহলে প্রতিবন্ধী শিশুদের চলার পথ যেমন মসৃণ হবে, তেমনি অভিভাবকদের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হবে। প্রতিবন্ধী নাগরিকের সমাজে অন্যসব নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার একটি মানবাধিকার, যা সংবিধান স্বীকৃত। তাদের প্রতি সব বৈষম্য দূরীকরণে সিআরপিডির বাস্তবায়ন জরুরি। এ ব্যাপারে সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ প্রয়োজন। উন্নয়নের মূলস্রোতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা গেলে তারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন। এ দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তাই আসুন বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস-২০২৩-কে সামনে রেখে আমরা সবাই মিলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করি এবং সেই সঙ্গে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close