মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ৩০ নভেম্বর, ২০২৩

মতামত

শিশু শিক্ষাই গড়ে তোলে জীবনের ভিত

বছরের শুরুতে ছেলেমেয়েরা নতুন শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চলতি বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে শুরু হবে বিভিন্ন স্কুলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম। তাই সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দিতে চোখে পড়ে শিশু ছেলেমেয়ের দল স্কুলে ছুটছে। ওদের কলকাকলিতে মুখরিত সকালের আকাশ-বাতাস। আজকাল সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন। অভিভাবকরা লেগে রয়েছেন সন্তানের পেছনে। সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফল করে নতুন ক্লাসে উঠবে, পরে ভালো কলেজে, ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাবে, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে- সন্তানের কাছ থেকে বাবা-মায়ের এটাই তো চাওয়া। ঢাকা শহরের বাইরেও ছোট শহরের স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা শিক্ষাগ্রহণ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। তবে ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ-সুবিধা বেশি রয়েছে। সরকারি স্কুল ছাড়াও রাজধানীতে বর্তমানে বেশ কিছু নামিদামি বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠেছে। বেশির ভাগ মা-বাবা, অভিভাবক তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করতে আগ্রহী। ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টারের অভাব নেই রাজধানী শহরে। বাড়ির সীমানা দেয়ালে, লাইটপোস্টের গায়ে সর্বত্র প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টারের প্রচারপত্র সাঁটা থাকে। মনভোলানো সব স্লোগান দিয়ে কোচিং সেন্টার, টিউটরের নাম, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সেল নম্বর লেখা থাকে এসব প্রচারপত্রে। নার্সারি, প্লে-গ্রুপ থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রয়েছে কোচিংয়ের ব্যবস্থা। কোনো কোনো প্রচারপত্রে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা পর্যন্ত থাকে। এসব দেখে শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকরা প্রলুব্ধ না হয়ে পারেন? বিত্তশীল পরিবারের সন্তানদের নামিদামি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করা যেন একট ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তাদের ধারণা, সরকারি স্কুল তো বিত্তহীনদের জন্য! ফলে রাজধানীর অনেক সরকারি স্কুলে পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা ও অভিজ্ঞ শিক্ষকম-লী থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিতসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। অথচ বিগত দিনগুলোতে সরকারি স্কুল থেকে অবতীর্ণ এসএসসি পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা ভালো ফলাফল করেছে। রাজধানীর বাইরের জেলা শহরের স্কুলগুলোতে ভালো ফল করা ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও ছিল অনেক। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এগিয়ে থাকত তারা। দেশের সর্বোচ্চ সরকারি পদগুলো ছিল তাদের দখলে। তখন বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ছিল কম। ছিল না প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং-ব্যবসা। শিক্ষকতা পেশাকে শিক্ষকরা নিতেন জনকল্যাণের ব্রত হিসেবে। ক্রমেই বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে সংকুচিত হয়ে আসা ভালো সরকারি স্কুলের স্থান দখল করে নিয়েছে বেসরকারি স্কুলগুলো। আর এ ধরনের স্কুলের সংখ্যা রাজধানীতেই বেশি। মফস্বলে ভালো মানের বেসরকারি স্কুল তেমন নেই বললেই চলে। ফলে সন্তানের লেখাপড়ার তাগিদে রাজধানীতে মানুষের চাপও ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ভালো স্কুলে ভর্তির প্রবল আগ্রহকে পুঁজি করে দেশব্যাপী চলছে কোচিং নামের জমজমাট ব্যবসা। শিশু ঠিকমতো হাঁটতে, কথা বলতে শেখার আগেই তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে। আর এ সুযোগে কোচিং সেন্টারগুলো শিশুদের স্কুলে ভর্তির নিশ্চয়তা দিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এমনকি রাজধানীর কিছু নামিদামি বেসরকারি স্কুলের বিরুদ্ধে রয়েছে ভর্তি-বাণিজ্যের অভিযোগ। তার পরও এসব স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য অনেক আগে থেকে ভিড় লেগে যায়। শিক্ষার্থীদের রীতিমতো নেমে পড়তে হয় ভর্তিযুদ্ধে। আজকাল কোচিং সেন্টার দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটা বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। সরকারি, বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জড়িত রয়েছেন এসব কোচিং সেন্টারের সঙ্গে। বিত্তশীল অভিভাবকরা সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে টাকা ঢালতে কার্পণ্য বোধ করেন না। টাকার বিনিময়ে সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দিতে পারলে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে যান। বেশির ভাগ কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা তো নির্দিষ্ট স্কুলেরও শিক্ষক। কোচিং সেন্টারের পেছনে টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে যদি সন্তান ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের আগাম আভাস পায়, তবে তো সোনায় সোহাগা! অথচ এ কাজটি করে তারা নিজ সন্তানের শিক্ষার গোড়ায় কুঠারাঘাত করছেন। শিক্ষিত মা-বাবা তাদের শিশুসন্তানটিকে নিজেরা বাসায় বসে পড়াতে পারেন। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতও করতে পারেন। অথচ তাদের সে সময়টুকু নেই। নিজেদের কর্মব্যস্ততার জাঁতাকলে শিশুসন্তানের লেখাপড়া, মনোবিকাশের দিকটা যেন ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হয়ে পড়েছে। সরকারি স্কুলে আজকাল শিক্ষা মন্ত্রণায়ের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় লটারির মাধ্যমে। অভিভাবকদের ধারণা, রাজধানীর তথাকথিত ‘এলিট’ স্কুলে একবার ভর্তির সুযোগ করিয়ে দিতে পারলে এসএসসি পর্যন্ত সন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যাবে। ওখান থেকে ভালো ফলাফল করে পরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আর ভাবনা থাকবে না। দেশের লেখাপড়ায় মফস্বলের স্কুলগুলো প্রধান ভূমিকা রাখলেও সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাব ও অবহেলার কারণে পিছিয়ে আছে। কাজেই সন্তানের শিক্ষার কারণে প্রধানত মানুষ হচ্ছে রাজধানীমুখী। রাজধানীর সব নামকরা স্কুলেই যে দক্ষ শিক্ষক ও সঠিক পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে, এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অথচ এ দুয়ের সমন্বয় ছাড়া একটা ভালো মানসম্পন্ন স্কুল গড়ে উঠতে পারে না।

নতুন শিক্ষাবর্ষে ১ জানুয়ারি স্কুলপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। শত প্রতিকূলতার মাঝে এ বছরেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। বছরের শুভ সূচনালগ্নে শিশুর কাছে নতুন বইয়ের গন্ধ এক সুখবার্তা বয়ে নিয়ে আসে। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখাপড়ার নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশে সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বর্তমান সরকার স্কুলে শিশুদের বিনামূল্যে বই সরবরাহ করে বেতনও ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে শিশুদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যেও পড়াশোনার বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শুধু বিনামূল্যে বই বিতরণই সুষ্ঠুভাবে শিক্ষাদানের সব কথা নয়। অনেক বইয়ের পাঠ্যবস্তু নির্বাচন, বইয়ের ছাপায় ত্রুটি থাকে। শিশুদের জন্য সহজ বোধযোগ্য সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মূল্যায়ন ও ফলাফল নিয়ে রয়ে গেছে নানা বিতর্ক। বিশেষ করে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে শিশুর জন্য অতিরিক্ত বিষয় অন্তর্ভুক্তির কারণে বইয়ের বোঝার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি বইয়ের বোঝা বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিও করা হয়েছে। দেশে আজও শিশুদের গমনাগমনের জন্য স্কুলবাস ব্যবহারের সুযোগ গড়ে ওঠেনি। পরিবারের নিজস্ব গাড়িও ব্যবহারের সুযোগ বেশির ভাগ শিশুর নেই। কাজেই অনেককে রিকশা বা ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হয়। নিম্ন ও নিম্নবিত্তের অনেক শিশুকে হেঁটে ভারী ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে যেতে তাদের ভার বহনজনিত স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাসে অতিরিক্ত বই সংযোজনের ছাড়া রয়েছে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। কখনো শিশু শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লেখকের গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হয়। এমনকি নির্দিষ্ট প্রকাশকের বই শিশুদের ওপর অর্থের বিনিময়ে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কোনো শিক্ষক যদি ক্লাসে শিশুকে পাঠ্যবই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুটি আন্তরিকভাবে বোঝাতে চান এবং বোঝাতে সক্ষম হন তাহলে একজন সাধারণ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য কোনো সহায়ক গাইড বইয়ের

প্রয়োজন পড়ে না। শিশুশিক্ষার্থীদের শিক্ষকের বকুনি, পিটুনিরও একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় কোনোমতে কাম্য হতে পারে না। প্রাক-প্রাইমারি ও প্রাইমারি স্তরের শিশুর জন্য

ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান, গণিত, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব সম্বন্ধে কতখানি জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে।

শিশু অবস্থায় লেখাপড়ার পরিধি যদি তার মস্তিষ্কের ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে, তবে তা পরবর্তী উচ্চতর শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এ কারণেই দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও উচ্চতর শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়ে। বর্তমানে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত পরীক্ষার্থীদের ছড়াছড়ির মাঝেও শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চতর পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শিশুর লেখাপড়ায় বয়সের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন বয়সের শিশু কোন ক্লাসে ভর্তি হবে তা নির্ধারণ করেন শিশুর মা-বাবা অথবা অভিভাবক, যা কাম্য নয়। বিভিন্ন বয়সের শিশু একই শ্রেণিতে পড়ায় শিক্ষার্থীদের একটি অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের কথা চিন্তা ইতোপূর্বে পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি স্কুলে মেধা যাচাই না করে লটারির ভিত্তিতে তৃতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে নানা মহলে বিতর্ক রয়েছে। স্বল্প সময়ের একটি পরীক্ষা নিয়ে এতটুকু বয়সের শিশুর কতটা মেধা সত্যিকারে যাচাই করা সম্ভব তা বিতর্কের বিষয় হলেও বিষযটি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। শিশু শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাক্রমে শিশুর মানবিক দিকগুলো প্রসারিত হয় এমন বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে খেলতে খেলতে বিদ্যার্জন করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরের সরকারি স্কুলে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া ছাড়া ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর শিক্ষার্থীর চাপ কমানো যাবে না। বেসরকারি স্কুলে যোগ্য, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগদানের ব্যবস্থা নিলে এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ভালো ফল করে দেখাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের বয়স ও তাদের শারীরিক, মানসিক ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের পাঠদান নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষাক্ষেত্রে সুবাতাস বয়ে দিতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close