নুরুন্নবী খোকন
মুক্তমত
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে
![](/templates/web-ps/images/news-logo.jpg?v=4)
শিশুদের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে পিতা-মাতা বা পরিবার যতটা উদ্বিগ্ন শিশুর মানসিক যত্নে যেন ততটাই উদাসীন। অথচ একজন শিশুর পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠার পেছনে শারীরিক ও মানসিক দু’ধরনের সুস্থ্যতায় অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে মানষিক সাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন গুরুত্ব চোখে পড়েনা। বিশেষ করে শিশুদের বেলায় তো নয়-ই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকায় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ‘এখানে ১৮ শতাংশের বেশি শিশু, কিশোর-কিশোরী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। গ্রাম-শহর কিংবা প্রান্তিক জনপদে সবখানেই শিশুদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে খুব বেশি কথা হয় না। শিশুদের অস্বাভাবিক আচরণকে সব সময় বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে’ এমন কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যার ফলাফল দিনকে দিন বাড়তে পারে। সব ধরনের অসুস্থতাতেই প্রাথমিক অবস্থায় যতটা সুচিকিৎসা সম্ভব, পরে সেটা আরো জটিল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। বলা বাহল্য, মানসিক সমস্যা বড়দের পাশাপাশি ছোটদের অর্থাৎ শিশুদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। যদিও আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা বা সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালা অপেক্ষাকৃত কম। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও অপ্রতুল।
যদিও আমাদের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে ২০০ থেকে ৪০০ শয্যার হাসপাতালে পরিণত করা হচ্ছে। আমাদের অনেক নীতি ও কৌশলের মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি ২০২২ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-৩০। এতদ্বাসত্ত্বেও আমাদের দেশের শিশুদের মানসিক বিকাশচর্চা কতটা অগ্রসর হচ্ছে, তা দেখা দরকার। কারণ একটি জাতীয় জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে, ৭ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মানসিক রোগের হার বেশি। গ্রাম থেকে শহরে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশি। সব ক্ষেত্রে মেয়েদের থেকে ছেলেদের সংখ্যা বেশি। স্নায়ু বিকাশজনিত উদ্বিগ্নতা, আচরণ, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি কারণে কারো কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। শিশু-কিশোরদের ৬ শতাংশ মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছে। আরো একটি গবেষণার বরাত দিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বিশ্বজুড়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাওয়া শিশুদের ১৫-২০ শতাংশই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা ইত্যাদি নানা মানসিক সমস্যায় ভোগে। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো মানসিক সংকটে ভোগা এই শিশুদের অধিকাংশই এ ধরনের সংকট থেকে উত্তরণে কোনো চিকিৎসা পায় না। একইভাবে করোনা মহামারিতে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপের প্রভাব পড়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ সময় লকডাউনে ঘরবন্দি অবস্থা স্কুল ও চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা থেকে দূরে থাকায় তাদের মানসিক চাপ বেড়েছে। একই সময় করোনা মহামারিতে অনেক শিশুই তাদের পিতা-মাতা ও আপনজন হারিয়ে ফেলেছে, সেটাও তাদের মানসিকতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ইউনিসেফের আরো একটি জরিপ থেকে জানা গেছে, ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগার প্রবণতা বেশি এবং এই বয়সি শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও ৮ শতাংশ ও ক্রমাগত বাড়ছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তাই শিশুদের মানসিক সমস্যাকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না বা অগ্রাহ্য করারও কোনো সুযোগ নেই। জাতিসংঘের ১৯৮৯ সালের গৃহীত শিশু অধিকার সনদেও শিশুদের কল্যাণের বিষয়টি সর্বোচ্চ বিবেচনায় এনে আইনপ্রণয়ন করার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬ দশমিক ২ ধারায় স্পষ্টভাবে শিশুদের শোষণ, নির্যাতন, পাচার ও শিশুদের বিরুদ্ধে সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধকরণ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছরের আগে। ৭৫ শতাংশ শুরু হয় ২৫ বছরের আগে। এডিএইচডি, দুশ্চিন্তা, অটিজম, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার, হতাশা, খাওয়ার ব্যাধি বা ইটিং ডিসঅর্ডার, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা এবং সিজোফ্রেনিয়াসহ নির্ণয়কৃত মানসিক ব্যাধিগুলো শিশু ও তরুণদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনের প্রাপ্তি এবং উপার্জনের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদিও শিশুদের জীবনের ওপর প্রভাব অগণিত, তবে প্রতিবেদনে উল্লিখিত লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি নতুন বিশ্লেষণ নির্দেশ করে যে, মানসিক অসুস্থতাজনিত কারণে তরুণদের অক্ষম হয়ে পড়া বা মারা যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়, তা প্রায় ৩৯ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ। আরো একটি তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।
সর্বোপরি শিশুদের প্রথম প্রতিষ্ঠান যেহেতু পরিবার তাই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি পরিবারকেই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। শিশুদের অস্বাভাবিক আচরণকে ওঝা, কবিরাজ, ঝাঁড়, ফুঁঁকের বশবর্তী না হয়ে সুচিকিৎসার দিকে
নজর দিতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি কাউন্সিলিং বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জনপদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সঙ্গে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলাপর্যায়ের জেনারেল হাসপাতালগুলোতেও শিশু মানসিক বিকাশ ইউনিট চালু করা সময়ের দাবি। একটি উন্নত জাতি বিনির্মাণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে ওঠা সবার একান্ত কাম্য।
লেখক : কবি ও কলাম লেখক
"