প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ২৮ নভেম্বর, ২০২৩

বিশ্লেষণ

দুবলার চরে রাস উৎসব

রাসলীলা বা রাসযাত্রা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি বার্ষিক উৎসব। রাস মূলত শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। ভগবান কৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথাবস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মার থেকে পরমাত্মায়, দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কামপ্রবৃত্তিসমূহকে প্রেমাত্মক প্রকৃতিতে রূপ প্রদান করে অঙ্কন করা হয়েছে।

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীরা সংসার ছেড়ে বৃন্দাবনে সমবেত হন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের সংসারে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেও গোপিনীরা তা অস্বীকার করেন। শ্রীকৃষ্ণের সংস্পর্শ পেয়ে গোপিনীদের মনে অহং জন্মায়। তাদের মন অহংপূর্ণ হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হন। পরে গোপিনীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে শ্রীকৃষ্ণের স্তব করা শুরু করেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণ ফিরে আসেন এবং গোপিনীদের কাছে জীবনের পরমার্থ বোঝান। তিনি গোপিনীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্ত করেন। এভাবেই রাশ উৎসবের প্রচলন ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের রাস উৎসব পালনের কথা আমরা প্রত্যেকেই শুনেছি। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এবং গিরিশচন্দ্রের পরবর্তী সময়কালে বাংলায় রাস উৎসব আরো জনপ্রিয় হয়। তবে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই যে ধূমধাম করে রাসযাত্রা উদযাপিত হয় তা কিন্তু নয়, পাশাপাশি বৃন্দাবন, মথুরা, ওড়িশা, অসম, মণিপুরেও আড়ম্বরের সঙ্গে রাস উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসবের মূল বিষয় রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা হলেও, অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে রাস পূর্ণিমা পালিত হয়।

রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্যও দুবলার চর দ্বীপটি বিখ্যাত। ভয়ংকর সুন্দর সুন্দরবন। সুন্দরবনে শুধু বাঘের ভয় নয়; প্রাকৃতিক দুর্যোগও প্রাণ কেড়ে নেয়। ভয়-আতঙ্ক, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়েই উপকূলীয় মানুষের মনে গড়ে উঠেছে উপকথা, পৌরাণিক কল্পকাহিনি রাসমেলা। প্রতিবছর সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যে রাস উৎসব হয়ে থাকে, তার পেছনেও রয়েছে এমন এক পৌরাণিক বিশ্বাস। রাস উৎসব মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বার্ষিক উৎসব। যদিও বর্তমানে এটি একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষের দিকে অথবা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকের ভরা পূর্ণিমার সময় এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীনে দুবলার চর। দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি চর হিন্দুধর্মের পুণ্যস্নান, রাসমেলার জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মধ্যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া এবং মেহের আলিরচর নিয়ে দুবলার চর গঠিত। দুবলার চর মূলত জেলেপল্লী। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। শীত মৌসুমে বহু জেলে চার-পাঁচ মাসের জন্য কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে দল বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা পূর্ণিমার জোয়ারের নোনা পানিতে স্নান করে পবিত্রতা অর্জন করার জন্য সেখানে গমন করেন। তাদের বিশ্বাস, এই স্নান তাদের পাপমোচন করে মনের সব উত্তম কামনা পূর্ণ করবে। প্রতিবছর কার্তিক মাসে রাস পূর্ণিমায় দুবলার চরে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা উপলক্ষে স্থানীয় দর্শনার্থীরা ছাড়াও বহু দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে ভিড় করে। অসংখ্য ভক্ত এই মেলায় পুণ্য অর্জনের জন্য সমুদ্র স্নান করে থাকে। খোল-করতাল, নাম সংকীর্তনের হরিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। এই মেলার আরেকটি আকর্ষণ হলো, চিরাচরিত মণিপুরি পোশাকে শিশুদের রাখাল নাচ ও তরুণীদের রাসনৃত্য। তিন দিনব্যাপী দুবলার চরের রাসমেলা সত্যিই অবর্ণনীয়। তথ্যমতে জানা গেছে, রাস উৎসব শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয়ভাব ধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথা বস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মার থেকে পরমাত্মায় রূপান্তরিত করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ উৎসব পালন করে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা বঙ্গোপসাগরের চর আলোর কোল এলাকায় বসে পূর্ণিমার জোয়ারে স্নান করে, যাতে তাদের সব পাপ মোচন হয়ে যায়।

যদিও, রাসলীলা নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে। এর মধ্যে বহুল জনপ্রিয় দুটি মত। এই দুই মতেই কেন এই রাসলীলা তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কথিত আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন ও পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এই থেকেই শুরু হয় রাস উৎসব। আবার অন্য মতাবলম্বীদের মতে, দুর্গাপূজার পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে লীলায় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় রাসলীলা পালিত হয়ে আসছে।

প্রতিবছর কার্তিক মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্যও দ্বীপটি বিশ্বখ্যাত। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে, তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন ১৯২৩ সালে এই মেলা চালু করেন। তবে দুবলার চরে রাস উৎসবের আয়োজন কীভাবে শুরু হলো- তা নিয়ে বহুজনের বহু মত পাওয়া যায়। মতভেদ রয়েছে এটি কবে শুরু হলো, সেটি নিয়েও। কেউ কেউ বলে থাকেন, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই উৎসবটি শুরু হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, তারও বহু আগে এ উৎসবটি শুরু হয়েছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে কীভাবে শুরু হয়েছিল- এ নিয়ে লোকমুখে নানা পৌরাণিক কাহিনি শুনতে পাওয়া যায়।

বিভিন্ন পুস্তকাদিতে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, সেসব মূলত লোককথার লেখা রূপ মাত্র। ১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সতীশচন্দ্র মিত্র রচিত যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থে এরূপ একটি উপাখ্যান উল্লিখিত আছে। যাতে বলা হয়েছে- অনেক দিন আগের কথা, বঙ্গদেশে ধনপতি নামে এক সওদাগর ছিল। নামের সঙ্গে তার কাজেও মিল ছিল। তিনি প্রকৃতপক্ষেই একজন ধনপতি ছিলেন। তার নিবাস ছিল খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগরে। সেই ধনপতি এক দিন সমবিহারে সিংহল যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, সমুদ্রের ওপর ফুটে রয়েছে এক মোহনীয় পদ্মফুল। আর সেই পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন অপরূপ এক দেবী। সওদাগর দেবীদর্শনের পর এ ঘটনা খুলে বলেন সিংহলের রাজা শালিবাহার আর তার মন্ত্রী গজাননের কাছে। বর্ণনা শুনে রাজা সওদাগরকে বললেন, এ তো দেবী কমলকামিনী। আমরা তার পূজা করি। কিন্তু তার দর্শন আমরা কোনোদিন পাইনি। রাজা দেবী দর্শনের জন্য সমুদ্রে নাও ভাসালেন। কিন্তু দেবী কমলকামিনীর দর্শন আর মেলে না। রাজা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সওদাগরকে বন্দি করে রাখলেন। এদিকে সওদাগর সমুদ্রযাত্রায় বের হওয়ার আগে সত্রী খুল্লনার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান রেখে যান। কিছুদিন পর সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় শ্রীমন্ত। বড় হয়ে শ্রীমন্ত তার মায়ের কাছে জানতে পারেন, তার বাবাকে সিংহল রাজা শালিবাহার অন্যায়ভাবে বন্দি করে রেখেছেন।

শ্রীমন্ত তার বাবাকে মুক্ত করার জন্য সিংহলের দিকে রওনা দিলেন। যাত্রাপথে সে-ও বাবার মতো পদ্মের ওপর দেবী কমলকামিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সিংহল পৌঁছে শ্রীমন্তও বাবার মতো রাজাকে এ ঘটনা খুলে বললেন। রাজা শ্রীমন্তকেও মিথ্যবাদী অপবাদ দিয়ে বাবার মতো বন্দি করে রাখলেন। এমনকি তাদের দুজনকেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেন। এবার কার্যকর করার পালা। এক দিন বলিকাঠে পিতা-পুত্রকে শোয়ানো হলো। জল্লাদ খড়গ দিয়ে মাথা ফেলে দেবে এখনই। এমন সময় অদৃশ্য দেবী কমলকামিনী দৃশ্যমান হলেন। তিনি বৃদ্ধার বেশে এসে রাজার কাছে পিতা ও পুত্রের জীবনভিক্ষা চাইলেন। সিংহল রাজা সহসা দেবীকে চিনতে পারলেন এবং নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। ফলে পিতা-পুত্রকে মুক্ত করে দিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তার রূপসী কন্যাকে সওদাগরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ধন-রত্ন ও মণি-মুক্তা বোঝাই করে বঙ্গদেশে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ সমুদ্রে গর্জন শুরু হলো। সওদাগরের তরী ডুবে গেল। এমন সময় দেবী কমলকামিনী পদ্মে ভেসে এসে তাদের উদ্ধার করে কুঙ্গা নদের মোহনায় পৌঁছে দিয়ে ফের অদৃশ্য হয়ে যান। এই কুঙ্গার তীরই হচ্ছে দুবলার চর। আর সেদিন ছিল রাস পূর্ণিমা তিথি। এরপর থেকেই কুঙ্গা নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দুবলার চরে মা কমলকামিনীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মা কমলাকামিনী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর চেহারার অধিকারী। এজন্যই সুন্দরী মেয়েদের বলা হয় কমলাসুন্দরী।

সুন্দরবনের এই দুবলার চরটি বিভিন্ন কারণে খ্যাতি লাভ করেছে। শীত মৌসুমের শুরুতে হাজার হাজার জেলে দলে দলে এই চরে মাছ ধরতে এসে অস্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। জেলেরা দিনভর সাগরে মাছ ধরে সন্ধ্যায় আগেই তারা ফিরে আসে। চরে মাছ শুকিয়ে তারা শুঁটকি মাছ তৈরি করে। এ দৃশ্যও অত্যন্ত উপভোগ্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close