মো. মারুফ মজুমদার

  ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

মতামত

যুদ্ধ শেষ হবে কখন

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের শেষ লাইনটিতে যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দেয়, যা পড়লে যেন মনে হয়, ইশ! আরেকটু হলে কেমন হতো অথবা এর শেষইবা কীভাবে কবে? এমন জিনিশ আমরা বাংলা সাহিত্যে দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্য যে প্রতিনিয়তই দু’নয়নের হিমশীতল অশ্রুর টালমাটাল হয়ে ঝরে পড়ে, তা নিয়ে লেখা যাবে একটি মহাকাব্য। বলছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের অরাজকতাপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থার আঁতুড়ঘর তথা বিশ্ব মানবতার বিমুখতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফিলিস্তিন সংকটের কথা। স্বদেশে যেন নিজেরাই আজ বিদেশি। এ যেন এক ব্যাখ্যাহীন নিষ্ঠুরতম, বর্ণনাতীত অমানবিক বর্বতার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাঁজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় সহস্র মানুষ প্রাণ হারায়। স্পন্দনহীন নিমেষ শূন্য হয়ে যায় চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। আর একজনও বেঁচে নেই। বলা হয়ে থাকে, তরুণ প্রজন্মই যেকোনো দেশের চাবিকাঠি। সেই জিয়নকাঠি শূন্য, মেরুদণ্ডহীন বর্তমান জাতির এই যে দুর্দশাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যের কারিগররা যেন বিশ্বমানবতার ওপর সজোরে চপেটাঘাত করে জানান দিল- এসব মানবাধিকারের বুলি আসলে ঠুনকো মায়াজাল। অত্যাচারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ফিলিস্তিন জাতির ওপর এক-এক করে ফেলছে আর অট্টহাসি হাসছে। তা নীরবে দেখে যাচ্ছে বিশ্ববিবেক।

২০২১ সালে মসজিদুল আকসার হামলা কারণ জানতে চেয়ে সে দেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আমাল জুদা বলেন, ‘এই সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ফলে ইসরায়েলি সরকারের উপনিবেশীকরণ নীতি, আল-আকসার একক আধিপত্য, ইহুদি বসতি চিরস্থায়ীকরণের অভিপ্রায়ই ছিল এই হামলার অন্যতম কারণ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ সংঘাতের ইতিহাস কী? এর নেপথ্যেইবা কারা? এর কি আশু সমাধান হবে? চলুন- এক এক করে জটলা বাঁধা প্রশ্নের প্যাঁচ খোলা যাক।

প্রসঙ্গত বলা ভালো, এ সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রো-ইসরায়েল লবি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। ওপেনসিক্রেট ডট কমের মতে, ২০১৮ সালে ইউএসে যে নির্বাচন সাইকেলটা চলছিল, সেখানে এই লবি ২২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। এ ছাড়া ইউএসের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সেক্টরে এই লবির যোগসাজশ ইউএসকে বাধ্য করছে চলমান সংঘাতে নীরব ভূমিকা রাখতে। পাশাপাশি জায়োনিজম (যা এক ধরনের পলিটিক্যাল মুভমেন্ট) অন্যতম অ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চল ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণে যায়। যার আইনি প্রক্রিয়ার নাম ব্রিটিশ ম্যান্ডেট। যার মেয়াদ ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার ঠিক আগে হিটলারের হলোকাস্টের বশবর্তী হয়ে একটি স্বাধীন ইহুদি জাতি প্রতিষ্ঠার তাগাদায় রথচাইল্ডের প্রেরিত চিঠির বার্তায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেলফোরের ঘোষণা ক্রমে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। ঠিক পরের দিন মিসর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইহুদিদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েল বা ইহুদিদের দখলে। ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ খাল নিয়ে সংকট তৈরি হয়, তখন ইসরায়েল মিসরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরপর এলো ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ৫ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যা ঘটেছিল, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের এই যুদ্ধের একদিকে ছিল মিসর আর সিরিয়া, অন্যপক্ষে ইসরায়েল। কিন্তু এই যুদ্ধের ছয় বছর পর ঘটল সেই ঐতিহাসিক সন্ধি। মিসর প্রথম কোনো আরব রাষ্ট্র যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করল। এরপর তাদের পথ অনুসরণ করল জর্দান। কিন্তু তাই বলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হলো না। গাজা ভূখণ্ড যেটি বহু দশক ধরে ইসরায়েল দখল করে রেখেছিল, সেটি ১৯৯৪ সালে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিল। সেখানে ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, সর্বশেষ ২০২৩ সাল।

একটি উটকো প্রশ্ন জাগে, ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যেই কেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়? এর কারণ দুটি। প্রথমটি ধর্মীয়, দ্বিতীয়টি জিওস্ট্র্যাটেজিক পজিশন।

প্রথমটি, ইহুদিরা বিশ্বাস করে বাইবেলে বর্ণিত পিতৃপুরুষ আব্রাহাম এবং তার বংশধরদের জন্য যে পবিত্রভূমির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, আজকের আধুনিক ইসরায়েল সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকেই অবশ্য এই ভূমি নিয়ে সংঘাত চলছে। মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)। ফিলিস্তিনিরা একের পর এক ইসরায়েলি টার্গেটে হামলা করছিল। আর ইসরায়েল আবার পাল্টা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছিল টার্গেট করে। দুপক্ষের এই ‘যুদ্ধ’ চলে বহু বছর ধরে। এরপর ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরায়েল একটি শান্তি চুক্তিতে সই করে। অসলো শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। যেখানে Two states solution তত্ত্ব সৃষ্টি হয়। তবে হামাস কখনোই এই চুক্তি মানেনি। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনে ঘোষণা দেন, তারা আর এই শান্তি চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য নন, কারণ ইসরায়েল এই চুক্তি মেনে চলেনি।

দ্বিতীয়টি, ফিলিস্তিনের অবস্থান তিন মহাদেশ (এশিয়া, আফ্রিকা ইউরোপ) সংলগ্ন। মানচিত্রে যদি তাকাই তাহলে দেখব ফিলিস্তিনের দক্ষিণে যে আকাবা উপসাগর রয়েছে- তা লোহিত সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। লোহিত সাগর সুয়েজ খাল (যাকে বিশ্ববাণিজ্যের ধমনি বলা হয়) দিয়ে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। সুয়েজ খাল থেকে ফিলিস্তিনের দূরত্ব ২০০ কিমি। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করার মুখক্ষম জায়গা ফিলিস্তিন।

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিরা বেশ কিছু ইস্যুতে মোটেই একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে আছে : এক, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে? দুই, পশ্চিমতীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে নাকি সরিয়ে নেওয়া হবে? তিন, জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে? আর সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে-

ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন, যা মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফিলিস্তিনিকে একটি পর্যবেক্ষকে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু জাতিসংঘের স্বীকৃতি না মিললেও এই বিশ্ব সংস্থার ৭০ ভাগ সদস্য রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। (সাধারণ পরিষদের ১৯২টি দেশের ১৩৪টি দেশ)।

২০১৫ সালের সেপেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে ফিলিস্তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও স্বীকৃতি মিলে। ২০১৩ সালে বিবিসি ২২টি দেশে একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে দেখা যায়, পুরো পশ্চিমা দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে জনমত ইসরায়েলের পক্ষে সহানুভূতিশীল। যেখানে প্রো-ইসরায়েল লবির গভীর সম্পর্ক সহজে অনুমেয়। শুধু তাই নয়, এই দুদেশ ঘনিষ্ঠ সামরিক মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্য পায় ইসরায়েল। এই সাহায্যের একটা বড় অংশই খরচ হয় ইসরায়েলের জন্য সামরিক অস্ত্র কেনার জন্য।

অন্যদিকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস একসময় মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। কিন্তু মিসরের সেনাবাহিনী ইসলামপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সেখান থেকে হামাস আর কোনো সমর্থন পায়নি। ২০২১ সালে ইতিহাসের আরেক নির্মম ঘটনা, জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ আল-আকসায় লাইলাতুল কদরের নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে কট্টরপন্থি ইহুদি ও ইসরায়েলি সেনারা। বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলি অমানবিক নির্যাতন-অত্যাচার পরিদৃশ্যমান।

আল-আকসা কেন ইম্পোর্টেন্ট ফ্যাক্টর?

১৯৬৭ সালে পুরো জেরুজালেম দখলে নেওয়ার পর থেকেই আল-আকসা মসজিদ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ইসরায়েল। জেরুজালেমের এই জায়গাটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও। ইহুদিদের কাছে এটি টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, বছরের পর বছর চলতে থাকা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে এই পবিত্র মসজিদ। মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হলো এই মসজিদ।

মোদ্দাকথা, গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোনো সমাধান এখনো মেলেনি। ভবিষ্যৎ তাহলে কী? সংকট সমাধানের সর্বসাম্প্রতিক উদ্যোগটি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটিকে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছিল একেবারেই একতরফা একটি উদ্যোগ বলে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ নিয়ে আসলে কাজ মোটেই এগোয়নি। ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তি চুক্তির আগে দুপক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। সেটি যত দিন না হচ্ছে, দুপক্ষের এই সংঘাত চলতেই থাকবে। মনে পড়ে গেল সৃষ্ট সংঘাত নিয়ে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের লেখা বিখ্যাত সেই খণ্ড কবিতাটি। তা হলো : ‘সে বলল- আমাদের দেখা হবে কবে/বললাম- যখন যুদ্ধ শেষ হবে/সে বললো- যুদ্ধ কখন শেষ হবে/বললাম- যখন আমাদের দেখা হবে। মনের গহিনে জেগে ওঠে, এ যুদ্ধের কি শেষ হবে? যদি হয়, তা কবে?

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close