রাশিদুল হাসান
মুক্তমত
স্বাধীনতা থেকে বিজয়
১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে চলমান পাকিস্তান ও এমসিসির মধ্যে ক্রিকেট খেলা অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার দর্শক, ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ৩ মার্চ পল্টনের মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ওই সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পড়ন্ত বিকেলে তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পরিচালিত হয়। ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঢাকাসহ সমগ্র দেশ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসভবন ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ দেশের প্রতিটি সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ঢাকায় পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার ও আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমঝোতা নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ‘ওই কালরাতে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার নেতৃত্বে বাকি ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অপারেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ঢাকার অপারেশনে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আরবাব। সামরিক অভিযানের কোড নেইম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। রাত সাড়ে ১১টা থেকে ওয়্যারলেসগুলো সচল হয়ে উঠল। নির্ধারিত সময়ের আগেই খুলে গেল দোজখের দরজা। ঢাকার পিলখানা, ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের আবাসিক কোয়ার্টার, জগন্নাথ হল, তদানীন্তন ইকবাল হল প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।’ (ব্রিগেডিয়ার সালেক সিদ্দিক, উইটনেস টু স্যারেন্ডার) হাজার হাজার নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়; যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে বর্বরোচিত গণহত্যা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে (০০ : ২০ মিনিটে) পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছো, যাহার যাহা কিছু আছে, তাহাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’ (অনূদিত) অতঃপর রাত ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় (উইটনেস টু সারেন্ডার)। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। এ বার্তাটি ওয়্যারলেসের ডিএইচএফ চ্যানেলে মগবাজার থেকে ভোরে চট্টগ্রামের সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠানো হয়। স্বাধীনতার এ বার্তাটি চট্টগ্রামের বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাতিসংঘের জাহাজ এমভি মিনি-লা-ট্রিয়া, গ্রিক জাহাজ এমভি সালভিস্তা ও ভারতীয় জাহাজ এমভি গীরির ভিএইচএফ চ্যানেলের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়।
১ এপ্রিল (১৯৭১) বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারকৃত অবস্থায় ঢাকা থেকে লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। লয়ালপুর মার্শাল ল’ কোর্টে মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীর মামলা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে ১ ডিসেম্বর লয়ালপুর জেল থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তর করা হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিংক প্রথম ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খবরটি ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেন। আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ঢাকাসহ সমগ্র দেশের বর্বরোচিত গণহত্যার চিত্র ১৫ জুন সানডে টাইমসে প্রকাশ করেন, যা সমগ্র বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় এবং বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ২৭ মার্চ ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি টেলিগ্রাম পাঠান, যার শিরোনাম ছিল ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’। ৬ এপ্রিল দ্বিতীয় টেলিগ্রাম পাঠানো হয়, তার শিরোনাম ছিল ‘ব্লাড’। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত যে নৃশংস গণহত্যা চালানো হয়, সেখানে মানবতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়, যা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার-শাসিত মার্কিন সরকার বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা শপথগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের আকাশে যে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়, দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত সেই স্বাধীনতার সূর্যটি ১৬ ডিসেম্বর রাহুমুক্ত হয় এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখক : সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ
"