তানজিব রহমান

  ২৫ মার্চ, ২০২৩

বিশ্লেষণ

দেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় র‌্যাবের ভূমিকা

‘বাংলাদেশ আমার অহংকার’- দেশপ্রেমের এ স্লোগান ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সুপরিচিত এলিট ফোর্স র‌্যাব। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ যাত্রা শুরু করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবের কার্যক্রম। বাংলাদেশের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অত্যন্ত চৌকস, মেধা, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব পালনে র‌্যাব অল্প সময়ে সবার কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। জঙ্গি, মাদক, সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা বন্ধে বর্তমানে সারা দেশে র‌্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়নে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯ মার্চ র‌্যাব তার ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, র‌্যাব পবিত্র রমজান মাসের কারণে এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন ১৯ মার্চ এগিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি অনন্য এলিট ফোর্স হিসেবে দিনটি র‌্যাবের কাছে যেমন আনন্দের এবং গৌরবের একইভাবে তা বাংলাদেশের জন্য ও অত্যন্ত গর্বের। বিশেষ করে উন্নত বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় র‌্যাবের যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ও অনন্য সাহসী ভূমিকা রয়েছে তা একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলাকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করতে এরই মধ্যে সক্ষম হয়েছে। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন ও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় অল্পদিনের মধ্যেই র‌্যাব বাংলাদেশের একটি আস্থার জায়গা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

দেশকে মাদকমুক্ত করতে সবার প্রতি এগিয়ে আশার আহ্বান ছিল ‘চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ও র‌্যাবের কঠোর অবস্থান। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারিসহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে; অবৈধ মাদকের ব্যবহার ও বাণিজ্য নির্মূলকরণে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন, অভিযান, মাদকের খারাপ দিক সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা জনসচেতনা সৃষ্টি করে। ফলে হাজারো তরুণ নতুন জীবনের সন্ধান ফিরে পায়। দুর্নীতি, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নে র‌্যাব সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষভাবে জঙ্গিবাদ, বনদস্যু, জলদস্যু দমন ও নির্মূলে র‌্যাব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ধর্মীয় মৌলবাদের মূলোৎপাটন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা দমন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেজাল খাদ্যদ্রব্য এবং মানহীন নকল ও অবৈধ ওষুধের অপবাণিজ্য রোধ, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া রোধকরণসহ বিভিন্ন সমসাময়িক আর্থসামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে অবিরত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও অপরাধীদের কৌশল যেমন পাল্টেছে, তেমনি সমাজে নতুন নতুন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এরই বাস্তবতায় এলিট ফোর্স র‌্যাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধ দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে বর্তমান বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে সুন্দর বনকে দস্যুমুক্তকরণে র‌্যাবের অগ্রণী ভূমিকা, জলদস্যুদের নতুন জীবনদান, অপহরণের ঘটনায় ভুক্তভোগী মানুষের জীবন রক্ষায় র‌্যাবের সক্রিয় ভূমিকা, তাদের মানবিক কর্মকাণ্ডের পরিচায়ক।

জঙ্গিবাদ নির্মুলে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা ৩৩ ঘণ্টার অভিযানে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আমির শায়খ আবদুর রহমানকে সিলেটের শাপলাবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অভিযানটি সবচেয়ে বড় সাফল্য বাহিনীটির। পরে গ্রেপ্তার করা হয় সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানিসহ বিপুলসংখ্যক জঙ্গি। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য এলাকায় নতুন জঙ্গি সংগঠনের মুখোশ উন্মোচন ও তাদের গ্রেপ্তারেও র‌্যাবের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বর্তমানে জামায়াতুল আনসার আল হিন্দাল শারক্বীয়ার অপতৎপরতা উদঘাটনেও র‌্যাবের অগ্রণী ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখা বলছে, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখের বেশি সন্ত্রাসী এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। গত ১৮ বছরে ২৯২৯ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০২২ সালে ১২৪টি অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ১৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে জেএমবির সদস্য রয়েছে ২৯ জন ও জামায়াতুল আনসার আল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৬৮ জন ও কেএনএফের ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে একই সময়ে ৪৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৭৯১ জনকে, ৬৭৫ জলদস্যু, ১৬০ বনদস্যু, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০৬৫ জন, অপহরণের অভিযোগে ৪ হাজার ৫৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নারী ও শিশু পাচারের অভিযোগে ৩১৭ জন, যৌন হয়রানি এবং ইভটিজিংয়ের অভিযোগে ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যা অপরাধীদের মানবিক ও নতুন জীবনদানের নামান্তর।

মানবাধিকার রক্ষায়ও তাদের আছে অনেক সুনাম। সুন্দরবনের দস্যুদের নতুন জীবনদান, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অপহৃত শিশু কিংবা অনেককেই উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে র‌্যাব অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। দেশের যেকোনো আপদকালীন সময় ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগময় সময়ে র‌্যাব দুর্গতের ভাসমান হাসপাতালের মাধ্যমে সেবা প্রদান, ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা জনকল্যাণমুখী মানবিক উদ্যোগেও সম্মুখসারির যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তারা। ‘নবজাগরণ’ কর্মসূচির মাধ্যমে অপরাধ জগৎ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ও একটি মানবিক উদ্যোগ তাদের রয়েছে। কিছু বিপথগামী র‌্যাব সদস্য এ বাহিনীর আদর্শবহির্ভূত কাজে লিপ্ত হয়ে বদনাম ছড়ালেও তাদেরও আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হয়।

মিথ্যা তথ্যকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের অর্থলগ্নি লবিস্টরা মার্কিন প্রশাসনকে ভুল তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে মিথ্যা বুঝিয়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। যার ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এ বিশেষ বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে র‌্যাবে বিশাল অগ্রগতি হয়েছে বলে তিনি এবং তারা মনে করছেন’। তিনি আরো বলেন, ‘এটা প্রমাণ করছে, মানবাধিকার রক্ষা করেই সন্ত্রাস প্রতিরোধ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো র‌্যাব করতে সক্ষম।’ তাই আমরা আশা করি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের শান্তি-শৃঙ্খলায় র‌্যাবের অনন্য ভূমিকা আরো উজ্জ্বল ও গতিশীল হবে। সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে র‌্যাব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close