মোহাম্মদ এনামুল হক

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩

মুক্তমত

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

আমাদের দেশে কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কিংবা চীন ও ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে? পরাশক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? আগামী বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে? একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

এই তো স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতি ভারত-রুশ প্রভাব কিংবা ৭৫-এ জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর সেনাশাসিত আমলে পশ্চিমাদের প্রভাব। এখন কি সে প্রভাব আছে? নিশ্চয়ই নেই, এখন আমাদের স্বার্থ আদায়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করার সক্ষমতা হয়েছে।

আগামী বিশ্ব রাজনীতি ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরেই হবে এটা স্পষ্ট হয়েছে একুশ শতকের ১ম দশকেই। যেসব কারণে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে তা হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের উত্থান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক, ভূকৌশলগত গুরুত্ব, এই অঞ্চলের দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে উদীয়মান শক্তি এবং আসিয়ানের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ভারসাম্য বজায় রেখেছে। অধিকন্তু, ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক পথ।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইন্দো প্যাসিফিক গুরুত্ব বাড়ার সাথে বে অব বেঙ্গলের গুরুত্ব বাড়ে।

বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে এটি বাংলাদেশের সাথে জড়িত। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বেই মূলত বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। গুরুত্ব বাড়ার কারণগুলোর মধ্যে আছে, ১. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে বঙ্গোপসাগর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২. চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক পথ মালাক্কা প্রণালিতে মার্কিন ও তার মিত্রদের শক্ত অবস্থানের জন্য চীন বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর দিয়েছে। ৩. চীন এখানে বিকল্প পথ বের করা মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পলিসি দরকার কীভাবে চীনকে আটকানো যায়। সে হিসেবে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন অবস্থান থাকাটাও জরুরি তাদের দিক থেকে। ৫. ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে বে অব বেঙ্গলের সংযোগ। ৬. চীনের সাথে বাংলাদেশের সীমানা না থাকলেও চীনের খুব কাছাকাছি বাংলাদেশ সেই জন্য এখানে মার্কিন উপস্থিতি চীনের জন্য সুখকর নয়। ৭. অন্যদিকে ভারতের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র নীতি মার্কিন প্রশাসনের চোখ এড়ায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তাদের অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়। সে হিসেবে মার্কিন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে যাতে একটু হলেও ভারতকে চাপে রাখা যায়। ৮. ভারতেরও এই অঞ্চলের ওপর স্বার্থ আছে। সেভেন সিস্টার্স রাজ্যের সাথে বাণিজ্য সহজ করতে পারে এই অঞ্চল। তাই ভারতের রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব ভূমিকা পালন করছিল বন্ধু রাষ্ট্রের এমন আচরণ আমাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্ব রাজনীতি কিংবা পররাষ্ট্রনীতি আদর্শবাদে চলে না, চলে বাস্তববাদে তথা বন্ধু কিংবা শত্রু চিনে না। শুধু একটা জিনিস সেটা হলো জাতীয় স্বার্থ। ভারত এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থে সে ভূমিকা পালন করছিল। ৯. চীনের বেল্ট রোড অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনার অংশ বাংলাদেশ। ১০. দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক বাজারের অঞ্চল। তাই ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ।

সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে আমাদের অবস্থান তৈরি হয়েছে। এখন পরাশক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভৌগোলিক অবস্থান, উন্নয়ন ও জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি।

বঙ্গোপসাগরের কূলে রাখাইন প্রদেশে কায়োকুফু বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে চীন প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। সেখান থেকে ৭৭১ কিলোমিটার দূরে চীনের কুনমিং পর্যন্ত পাইপলাইন করেছে, যা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল-গ্যাস বঙ্গোপসাগর হয়ে চীনে চলে যাবে। বঙ্গোপসাগর কে হাব হিসেবে ব্যবহার করবে। তাই চীনের কাছে এই অঞ্চল ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। চীন এই অঞ্চলের বিষয় নিয়ে খুব সতর্ক ও শক্ত অবস্থানে থাকবে। অন্যদিকে মার্কিন নীতি বরাবরের মতো বিশ্বরাজনীতি, যে যখন তাদের সমকক্ষ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী হবে তাদের ঘিরেই হয়। সেহেতু আগামীতে তাদের বৈদেশিক নীতি চীনকে ঘিরেই হবে। সেই প্রেক্ষিতেই চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো হবে মার্কিন নীতির প্রথম টার্গেট।

চীন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও লক্ষ্য একটাই সেটা হলো তাদের স্বার্থ উদ্ধার। বাংলাদেশের কাছে উভয় রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমদানির দিক থেকে চীন, রপ্তানির দিক থেকে মার্কিন ও তার মিত্র ইউরোপ। সে হিসেবে বাংলাদেশকে দেখে-শুনে পা ফেলতে হবে। পাইলট ফিসের আচরণ প্রয়োগ করে নিজ স্বার্থ আদায় করার মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সাথে, আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক হতে হবে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপাক্ষিকতার মাধ্যমে সম্পর্ক বাড়াতে হবে এবং নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। পশ্চিমা ও চীন নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে গভীর সমস্যায় পড়ার সম্ভবনা প্রবল। সেই সাথে দক্ষ ও বিচক্ষণ নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কৌশলের সাথে ভারসাম্য ও জাতীয় স্বার্থ আদায়ের নিমিত্তে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় পরাশক্তিদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে জলাঞ্জলি দিতে হবে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব পড়বে হুমকির মুখে।

লেখক : শিক্ষার্থী

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close