মোতাহার হোসেন

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩

বিশ্লেষণ

সুপেয় পানির সংকট নিরসনে করণীয়

রাজধানীতে গ্রীষ্মে পানিসংকট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু গ্রীষ্মের পরও পানিসংকট থাকবে আগামী দিনগুলোতে এমন আশঙ্কা পানি ও নদী গবেষকদের। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘রাজধানীর পাশর্^বর্তী নদীসমূহকে দূষণমুক্ত করে পানির প্রবাহ বাড়ানো না গেলে ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে ঢাকা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকাতেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল ঢাকা মহানগরীতে। এখন ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করছে ওয়াসা। এতে ৯০০টি নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। নদীর পানিদূষণের অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক নলকূপ বসিয়ে যাচ্ছে। অথচ নদীর পানি দূষণরোধে কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানীতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অপরদিকে মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য ও শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে বেড়েই চলেছে নদীদূষণের মাত্রা। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ‘ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এ উদ্বেগজনক তথ্য ওঠে আসে। সম্প্রতি রাজধানীতে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে, দিন দিন রাজধানীতে বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে পানির চাহিদা। পানির বর্ধিত চাহিদা পূরণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ক্রমাগত বাড়তে থাকায় দ্রুত নামছে পানির স্তর। রাজধানীর বাইরে পানি উন্নয়ন বোর্ড সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ২৭২টি কূপের মাধ্যমে দেশের ভূগর্ভস্থ পানির বাড়া-কমা পর্যবেক্ষণ করে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে ১৩০টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। তখন সাড়ে ২২ মিটার নিচ থেকে পানি পাওয়া যেত। ২০০৫ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪২৩, পানির স্তর নামে ৫৪ মিটারে। ২০২০ সালে এসে নলকূপের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর পানির স্তর নেমেছে ৭৪ মিটার।

অন্যদিকে, কৃষিতে সেচের কাজে পানির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে। বোরো মৌসুমে সেচের পানির প্রায় ৭৫ ভাগের উৎস ভূগর্ভস্থ পানি। দেখা যাচ্ছে, সেচের জন্য ১৯৮৫ সালে দেশে নলকূপের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮০০। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ।

বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির স্তর প্রতি বছর নামছে এক ফুট করে। এক দশক আগে গড় নামার হার ছিল আধা ফুট। পানির খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির অপব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। পাউবোর ভূগর্ভস্থ পানি বিজ্ঞান পরিদপ্তর পরিচালিত কৃষিতে পানির অপচয় নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৫ ভাগ পানিই কাজে লাগে না। কৃষকের অনেকেরই ধারণা, বেশি পানি দিলে ফসল ভালো হয়। তাই তারা ইচ্ছেমতো পানি দেন।

ঢাকাসহ নগরের বাইরে উপজেলা পর্যায়ে পানির সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে ডিপিএইচই। ঢাকাসহ পাঁচ মহানগরে আছে পাঁচ ওয়াসা। আর সেচকাজে আছে বিএডিসি। ডিপিএইচই বা ওয়াসাগুলো বা বিএডিসির মতো পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূগর্ভস্থ পানির সুরক্ষায় কোনো দায় নেই। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার ৭০ ভাগ পানি ভূউপরিস্থ উৎস থেকে নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। পানিসংশ্লিষ্ট অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের মধ্যে সমন্বয় দরকার। অথচ বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালে বিধিমালা প্রণয়ন হয়। বিধিমালা অনুযায়ী, গৃহস্থালি ব্যবহার ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনে লাইসেন্স প্রদান, মনিটর করে যথেচ্ছ উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো ওয়ারপো। সেই ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে ওয়ারপোর কাজ দৃশ্যমান নয়।

প্রসঙ্গত বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের ফলে ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর বিরূপ প্রভাবে দেশেও ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে পরিবেশ প্রকৃতি। পরিবেশবিদদের মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮ শতাংশেরও বেশি জমি পানির নিচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালীর দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনি অবস্থায় পানিসংকট থেকে পরিত্রাণে ভূপৃষ্ঠের তথা ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারে বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর, জলাশয়, নদী ও খাল সংস্কারসহ ঢাকা ওয়াসাসহ সব নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য আবাসিক, অনাবাসিক এলাকায় সেপটিক ট্যাংক ও সোককূপ স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া; জলাধার রক্ষায় পানি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা; আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের পানি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহারে বাধ্য করা।

জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রণীত টেকসই উন্নয়নের ৬ নম্বর অভীষ্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন : পরিকল্পিত পানির উৎস সংরক্ষণ ও দক্ষ পানি ব্যবস্থাপনা’র মাধ্যমে সমাজের সকলের জন্য, বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুপেয় পানি ও পয়ঃব্যবস্থা নিশ্চিত করা।’ এই অভীষ্ট বাস্তবায়নে সহযোগী হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য অধিদপ্তর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত ও সচেতন করার লক্ষ্যে নানা ধরনের প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি অতিক্রম করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নগরায়ণ ও শিল্পায়ন আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। এতে পানি, বায়ু ও মাটির দূষণ বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হবে মারাত্মক হুমকি। দেশের পানি দূষণের জন্য মূলত দায়ী শিল্পী কলকারখানার বর্জ্য, নগর এলাকার বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক বর্জ্য, নৌযান থেকে নির্গত তেল, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও আর্সেনিক দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নদীগুলোর পানির স্বচ্ছতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজধানীর নর্দমার নোংরা পানি ও নগরীর কঠিন বর্জ্যরে চূড়ান্ত গন্তব্যে পরিণত হয় নদী। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬০ জেলার এক লাখ ২৬ হাজার ১৩৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি আর্সেনিক দূষণের শিকার। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এ সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকটও তীব্র হচ্ছে। দেশের উপকূলীয় এলাকার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে ভুগছে। ২০৫০ সাল নাগাদ ওই অঞ্চলের ৫২ লাখ দরিদ্র ও ৩২ লাখ চরম দরিদ্র মানুষ পানিসংকটের সম্মুখীন হবে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রাম ও শহর এলাকার সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহের অঙ্গীকারবদ্ধ। ইতোমধ্যে দেশের শতকরা ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ জনগণকে নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা করার দাবি সরকারি মহলের। আমাদের প্রত্যাশা, সংকট নিরসন করে সুপেয় পানির নিশ্চয়তায় সরকার সমন্বিত উদ্যোগ নেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close