মজিবর রহমান
দৃষ্টিপাত
বিজয়ের বার্তা ও বাস্তবতা
![](/assets/news_photos/2022/12/01/image-367750.jpg)
ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাস। মাসটি এলে আমরা যারপরনাই উদ্বেলিত হই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিই, কথাবার্তা বলি কিংবা শুনি। গান-বাজনা উপভোগ করি। বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব কর্মকাণ্ড মূলত শহরের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নামকাওয়াস্তে কিছু কর্মসূচি পালিত হয়। তবে মাদরাসা শিক্ষায় এসবের কোনো বালাই নেই। গোটা দেশে জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রকৃতির মাদরাসা- সেখানে অনুষ্ঠানাদি তো নয়ই, পতাকাটিও ঠিকমতো মর্যাদা পায় না। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের এসব আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে সংযোগ খুব সামান্যই। শহরের আমরা কতিপয় মানুষ যারা এই মাসটি নিয়ে মাথা ঘামাই তাদের উদ্বেলতার যথেষ্ট কারণও আছে। এ মাসেই বাঙালি জাতি তাদের সর্বোচ্চ শৌর্যবীর্য প্রদর্শন দ্বারা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর বিজয় হাতে আসে। বিজয়ের ইতিহাস আমরা কিছু মানুষ মাসজুড়ে জানানোর চেষ্টা করি, তাও আবার দুভাগে বিভক্ত হয়ে; দুই রকমভাবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হলো, কিন্তু এর ইতিহাস নিয়ে কাটাছেঁড়ার অবসান হলো না। মীমাংসিত বিষয়কে অমীমাংসার পর্যায়ে এনে ধূম্রজাল সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত হই স্রেফ রাজনৈতিক
কারণে। এ নজিরও বোধ করি নতুন ইতিহাস গড়তে চলল পৃথিবীতে। মর্মপীড়ার আরো বড় কারণ এই যে
ইতিহাসের মর্মার্থ আমরা অন্তরে ধারণ করছি না। চলমান বাস্তবতা এর উদাহরণ।
৯ মাসের যুদ্ধ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয়, ইতিহাসের একটি অংশ। এর বৃহদাংশ জুড়ে আছে সংগ্রাম আর সংগ্রাম, যে সংগ্রামের রূপ অক্ষয়-অমলিন। কী কঠিন ঐক্য আর দৃঢ়তাই না ছিল সেদিনের সেই সংগ্রামের! নেতৃত্বও ছিল অসাধারণ মানের, আদর্শ ও ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। নিজেদের জীবনের আরামণ্ডআয়েশ পরিত্যাগ করে দেশ ও দশের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন একেকজন রাজনীতিক। পরিবার-পরিজনকে বড় করে দেখতেন না, সংসার চলছে কি চলছে না তাকিয়ে দেখার ফুরসত পেতেন না তারা। কেবল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নন, জেলাপর্যায় কিংবা আরো নিচের সারির নেতারাও ছিলেন সমান পরীক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ। তাদের অধিকাংশের দিন কাটত টানাপড়েনের ভেতর, তবু আদর্শচ্যুত হননি। শ্রেণিগতভাবে নেতাদের সবাই ছিলেন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। মুসলিম লীগের উচ্চবর্গের নেতৃত্বের বিপরীতে তারা বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন নিজেদের পোড়খাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ যারা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন। এই সাধারণ মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে যেমন, পরও তেমন দরিদ্রক্লিষ্ট-অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে তুলছিল তাদেরই যারা পূর্ব থেকেই ভাগ্যবান ছিলেন। ভাগ্যহীনদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে মাঠে নেমেছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ এসব নেতাকে ছাড়িয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদের মতো সঙ্গীদের নিয়ে গড়ে তোলেন তুমুল সংগ্রাম। জেল-জুলুমণ্ডহুলিয়ার প্রচণ্ডতা দ্বারা তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। ৬ দফা ও ১১ দফার সংগ্রাম, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনী ম্যান্ডেটের বাধা পেরিয়ে একাত্তরে ৯ মাসের রক্তঝরা যুদ্ধের পর দেখা মেলে এই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো দেশপ্রেম বিযুক্ততা কিংবা আদর্শচ্যুত হননি তৃণমূলের নেতারাও।
বাস্তবতা বদলে গেছে ধীরে ধীরে। ঐক্য তিরোহিত হয়েছে, বিভক্তি এখন এমন পর্যায়ে উপনীত যা পদে পদে বাধাগ্রস্ত করছে জাতীয় অগ্রগতি। সেই সঙ্গে পিছু হটেছে আদর্শ, সামনে চলে এসেছে স্বার্থ হাসিলের রাজনীতি। এ রাজনীতি এমনই কদর্য রূপ নিয়েছে বর্তমানে যে সাধারণ মানুষ এর প্রতি আস্থা হারাতে বসেছেন। দলাদলি আর কোন্দলে অস্থির হয়ে উঠেছে সমাজ। খোদ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনও মারামারি-কাটাকাটির ঘটনায় কলঙ্কিত। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থ ও পেশিশক্তি। মানুষের কল্যাণের জন্য যে রাজনীতির অভ্যুদয় তা এখন পরিণত হয়েছে অর্থ রোজগারের হাতিয়ারে। এমন হালচাল মোটেও শুভ নয় জাতির জন্য। যারা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। নয়তো সমাজ পশ্চাৎমুখী হবে। উন্নয়নের স্বাদণ্ডবিস্বাদ ঠেকবে একসময় মানুষের কাছে। রাজনৈতিক পরিবেশের উৎকর্ষ ঘটানো ছাড়া সমাজদেহের ক্ষত সারানো যাবে না। নৈতিক অবক্ষয়ের রমরমা রূপ প্রত্যক্ষ করছি আমরা এ সময়ে, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চরমে। নতুন প্রজন্ম এ নিয়ে হতাশ, দেশের প্রতি মমত্ববোধে ক্ষয় ধরছে তাদের। যাদের গতি আছে তারা এমনকি দেশ ছাড়তেও উৎসাহী। মেধাবীরা সুযোগ পেলেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে দেশ মেধাশূন্য হওয়ার ফাঁদে পড়বে। বিজয়ের বার্তাকে অম্লান রাখতে চাইলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্বাধীনতাণ্ডসংগ্রামের কর্মীদের ভেতর ছাত্রসমাজ ছিল প্রধান এক শক্তি। সম্পূরক ১১ দফার সংগ্রাম দ্বারা ৬ দফার সংগ্রামকে বেগবান করেছেন তারাই। উনসত্তরে আইয়ুব খানের পতনের সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা মুখ্য ছিল। আজকের ছাত্রসমাজ গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া পুনঃপ্রবর্তনের যে দাবি তুলতে পারছেন তা পূর্বসূরিদের অবদান। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রণীত ওই ১১ দফাতেই শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি তোলা হয়েছিল। কোনো রকম প্রজ্ঞাপন ছাড়াই তাদের সে দাবি বাস্তবায়িত হয়ে যায়। টিকিটের অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করে সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সুযোগসহ আরো কিছু বাড়তি সুযোগ মেলে তখন। এসবই ঘটেছিল ছাত্ররাজনীতির বিশেষ অবদানের প্রতিদানস্বরূপ। ছাত্রসমাজ পরে স্বাধীনতাযুদ্ধে অমূল্য অবদান রাখেন। মূল রাজনীতির মতোই ছাত্ররাজনীতিও তখন আদর্শপ্রধান ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিল। আজকের দিনে এই ছাত্ররাজনীতি কতটা অধঃপাতে গেছে ভাবতেও বিস্ময় বোধ হয়। ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে হেন অপকর্ম নেই যাতে তারা জড়াচ্ছে না। বুয়েটের আবরার হত্যার ঘটনা তো রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে মূল রাজনীতিই তাদের এমন কদর্য বানিয়েছে। অতএব পরিশীলিত হওয়া উচিত মূল রাজনীতিই, তাতে ছাত্ররাজনীতিও কলুষমুক্ত হবে। ভাবার কারণ নেই যেসব রাজনৈতিক দল ও সব রাজনীতিক এবং সব ছাত্র সংগঠন ও সব ছাত্র কর্মী আদর্শবিচ্যুত হয়ে গেছেন। অনেকেই আছেন মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ থাকতে চান। কিন্তু তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ। এই ক্ষীণকণ্ঠ যতদিনে না উচ্চকণ্ঠ ও দলে ভারী হবে ততদিন প্রকৃত মুক্তি আসবে না, শুধু দৃশ্যমান কিছু উন্নতি আমরা চাক্ষুষ করে যাব। অথচ স্বাধীনতার পাশাপাশি মুক্তির ডাকটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একাত্তরের ৭ মার্চ সে রকম বার্তাই দেয়।
বিজয় ত্বরান্বিত করার জন্য শ্রমিক-কৃষকের ভূমিকাও ছিল অসাধারণ। শ্রমিকরা তো সক্রিয় ছিলেনই, পাশাপাশি দুরন্ত ভূমিকা পালন করেছে কৃষকসমাজ। বাংলাদেশ তখন একান্তই গ্রাম ও কৃষিপ্রধান। যুদ্ধে গিয়েছেন কৃষকের সন্তানই বেশি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের প্রধান অবলম্বন ছিল গ্রাম ও গ্রামের কৃষক পরিবার। বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়েছে কৃষক সমাজই বেশি। তাদের জন্য রাষ্ট্রের যতটা করার ছিল তা করা হয়নি। কৃষকের অনেকেই দিন দিন ভূমিহীন হচ্ছেন, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য হিস্যা বা উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। প্রভাবশালী মহল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কাছে হার মানছে তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রম। বিজয়ের বার্তা কৃষিজীবীদের কাছে ফিকে হয়ে উঠেছে। শ্রমিকরাও অধিকারহীন। বিজয়ের মাস তাদের স্মরণ করে না। স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন সব ধর্মমতের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন সব স্বাধীনতাকামী। সেই চেতনা সুপ্ত ছিল পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা অবধি। ধীরে ধীরে সেই চেতনার অবলুপ্তি ঘটতে চলেছে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা চাপে আছেন। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতায়। ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি তাদের দলীয় মেনোফেস্টোর অনুষঙ্গ এখনো। অথচ তাদের শাসনামলেই কুমিল্লায় মন্দিরে হামলার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটল, যার রেশ ছড়াল দেশের অন্যত্র। বঙ্গবন্ধুর আত্মা কি এরপর শান্তি পাবে?
মুজিবনগর সরকারের একাত্তরের ১৭ এপ্রিলের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছিল। সংবিধানের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে শোষণমুক্ত ন্যায়ানুগ সাম্যবাদী সমাজের কথা বলা হয়েছে। বিপরীতে আমরা পাচ্ছি ক্রমবর্ধমান বৈষম্যযুক্ত এক সমাজ। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও সুরাহার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বৈষম্যের এই বাড়বাড়ন্ত অবস্থার রাশ টানতে না পারলে বিজয়ের বার্তা অর্থবহ হবে না।
লেখক : কলামিস্ট
"