ইমরান হোসাইন

  ২৯ নভেম্বর, ২০২২

মুক্তমত

ফুটবল উন্মাদনা হোক বৈরিতাবিহীন

বাঙালির ফুটবল ঐতিহ্য ও ইতিহাস বেশ পুরনো। এ খেলাটি আমরা বাঙালিরা মনেপ্রাণেই ভালোবাসি ও লালন করে থাকি। কালের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশ বেশ পরিচিত হয়ে গেছে। ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের ঐতিহ্য থাকলেও বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে ক্রিকেট দিয়ে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, বাঙালিরা আবেগের ওপর বেশি ঝুঁকে থাকে। আর সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেটসহ নানা খেলা নিয়ে। বিশেষ করে ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়ে আমরা বেশি মাতামাতি করি।

দেশে মাঠের লড়াই শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গেছে ঘরের লড়াই। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা- এ দুই দলে ভাগ হয়ে গেছেন অনেকে। আবার অন্য দলের সমর্থকও কেউ কেউ। বাসার ছাদ থেকে বসার ঘর, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সব জায়গাতেই প্রিয় দলকে নিয়ে পক্ষপাতের লড়াই। ঘরে ঘরে ফুটবলের ভক্তরা জড়িয়ে পড়ছে নিজের দলকে নিয়ে বাগযুদ্ধে। আদরের ছোট বোনটা মতবিরোধের কারণে ভাইকেই মনে করছে ঘোর শত্রু! বাংলাদেশীদের ফুটবল প্রেমে আমি দোষের কিছু দেখছি না। তবে দোষটা তখনই হয়, যখন এই খেলাকে কেন্দ্র করে, সমাজে দুর্গন্ধ ছড়ানো হয়। সমস্যা হয় তখন, যখন ভিনদেশীদের ফুটবলার কিংবা দেশ নিয়ে গুজব রটানো হয়। বিদ্বেষের বিষ লালাকারে যত্রতত্র মেশানো হয়।

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এই আবেগ, উচ্ছ্ব¡াস আর উন্মাদনা কখনো-সখনো নোংরামিতেও পরিণত হয়। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তা অনেক সময় বড় বড় শত্রুতার ঘটনাকেও হার মানায়। নিজ দেশেই যেন জাতি বড় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই দুই দলের সমর্থক সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভিনদেশি দলকে সমর্থন করতে গিয়ে অনেক সময় দেশি ভাইদের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক, হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। যা খুন খারাবি পর্যন্ত গড়ানোর নজিরও আছে। এছাড়া ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন, এমন উদাহরণও আছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত বিশ্বকাপে নারায়ণগঞ্জে আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলের তারকা নেইমারকে নিয়ে বাগবিত-ায় ছুরির আঘাতে বাবার মৃত্যু ও ছেলে গুরুতর আহত হয়েছে। এছাড়া ১২ বছর বয়সী এক কিশোর ব্রাজিলের পতাকা রাস্তার পাশের খাম্বায় টানাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন।

এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণাত্মক, কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল মন্তব্য তো আছেই। ব্রাজিলের সমর্থকরা আর্জেন্টিনার পতাকাকে প্যান্ডেলের কাপড় আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা ব্রাজিলের পতাকাকে মলের রঙের সাথে তুলনা করেন। এসবের মধ্য দিয়ে তারা একে অন্যকে ছোট করতে গিয়ে নিজেরাই ছোট হন। প্রশ্ন হলো, যারা ফুটবল বিশ্বকাপের সময় এমন আচরণ করেন, তারা কি আসলেই ফুটবলকে ভালোবাসেন? তারা কি জেনে-বুঝে এমনটি করেন? তারা কি বোঝেন না, এসবের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদেরই ছোট করছেন? আমার ধারণা, বেশিরভাগ সমর্থকই তাদের নিজের পছন্দের দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় সম্বন্ধেও জানেন না। এমনকি সব খেলোয়াড়ের নামও বলতে পারবেন না। আর একটি বিষয় হলো, আপনি যে দলকেই সমর্থন করুন না কেন, কোন খেলোয়াড় বা কোন টিম ভালো খেলল, তা নিয়ে আপনি বাজে মন্তব্য করতে পারেন না। অনেককেই দেখেছি নিজের পছন্দের সাথে মিল না থাকায় বিদ্বেষ থেকে মেসি, নেইমার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো খেলোয়াড়ের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। যারা এসব খেলোয়াড়ের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা আসলে কতটা ফুটবলপ্রেমী বা খেলা বোঝেন, তা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, যাদের জন্য আমরা এসব করছি তারা তো জানেই না যে তাদের এত ভক্ত বাংলাদেশে আছে আর সবাইকে চেনা তো দুরের কথা! এমনকি তাদের নিজেদের দেশের মানুষেরা তাদের নিজেদের দেশের খেলা শুধু উপভোগ করে কিন্তু আমাদের মতো এরকম করে কি না আমার জানা নেই। অবশ্যই সাপোর্টার হতেই পারি কিন্তু তাই বলে অন্য কোনো দেশের খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কেন মারপিট, ঝগড়া, ছোট করা, হেয় করা এমন কী আত্মহত্যা! দিন শেষে এই অতি সিরিয়াস ভক্তরাই কিন্তু নিজেকে মানসিক বা শারীরিকভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তাতে কি আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের কিছু আসছে যাচ্ছেছ?

আমরা বাঙালিরা যেমন ভোজনরসিক, তেমনি নানা বিনোদনধর্মী শাখায় নিজেদের বিনোদিত করতে সবাই ভীষণ ভালোবাসি; তা সিনেমা হোক বা খেলা কিংবা এ জাতীয় কিছু। এ ধরনের আনন্দপ্রেমী জাতি হিসেবে খুব গর্ববোধ করি, কিন্তু পাশাপাশি

যখন দেখি বা শুনি আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের

মতো ভিন্ন দেশের খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট, রেষারেষি, গালাগালি,

তর্কাতর্কি, গণ্ডগোল, আহাজারি এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে-

তা সত্যি দুঃখজনক। তাই প্লিজ, প্রিয় কোনো দলের প্রতি ভালোলাগা বা সাপোর্ট থাকতেই পারে এবং অবশ্যই তা সম্মান করি কিন্তু তা যেন নিজেদের ক্ষতি করে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close