অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

  ২৮ নভেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ ডা. মিলন

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় ঐতিহাসিক সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুমূর্ষু মানুষের সেবায় সদাব্যস্ত এ সংগঠনের সদস্যরা।

এ দেশের মানুষের কাছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথিকৃত বিএমএ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিকেলের পাশে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী চিকিৎসকরা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। সেই গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণায় ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ আমরা সেই বিএমএর সদস্য হতে পেরে সত্যিই গর্বিত।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সব পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন; স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সেই জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। আবারও এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। সেই স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্র উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সব মতের, পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই ছিল স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ। তাই ঢাকা শহর সে সময় পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফর উল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে এ দেশের জনগণের ওপর টিক্কা খান সরকারের মতো চাপিয়ে দেওয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সব পেশাজীবীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরো বেগবান করে।

অতঃপর এলো ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। সারা দেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহুত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএর মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম স¤পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন।

পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমের সময় তাদের রিকশা লক্ষ করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে রিকশা করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। সবাইকে কাঁদিয়ে তার প্রিয় মেডিকেল কলেজেই শহীদের বেশে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অথচ এ কলেজেই তিনি পড়েছিলেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছিলেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে।

ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয় এবং অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। স্বার্থক হয় মিলনের আত্মদান।

শহীদ ডা. মিলন এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে মিলন যুগ্ম স¤পাদক ও আমি দপ্তর স¤পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একই সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করতাম। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএর কাজে বা পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। চিকিৎসকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি, যা তার নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই প্রতীয়মান হয়।

১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএর বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে সব চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই সময় বিবিসি রেডিও থেকে টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়, তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয় কথা বলতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।

শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদতবার্ষিকীতে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। এ দেশের হাজার হাজার চিকিৎসকদের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল।

মাঝে মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়সও আজ ২৭ বছর। ডা. মিলন যে ধারণ করে, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মহুতি দিয়েছিলেন, অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছে।

এরই মধ্যে গণমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১২ প্রণয়ন, ১৩৬২ আইএসটি শিক্ষক-চিকিৎসকদের চাকরি নিয়মিত করা, ডিপিসির মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, উচ্চতর ও উন্নত চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট এবং খুলনায় আরো চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নতুন নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত মেডিকেল ইনস্টিটিউট-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু-মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, গড় আয়ু বৃদ্ধি ও কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠার মধ্যে অন্যতম।

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখন পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এরই মধ্যে বিনামূল্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের টিকাদান স¤পন্ন হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘গুড হেলথ অ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি।

বলা যায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। সম্প্রতি সরকার জনগণের জন্য স্বাস্থ্য বিমা ও মেডিকেল হেলথ কার্ড প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন জাতীয় ঔষধ নীতিও প্রণয়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান আরো বৃদ্ধির লক্ষ্যে অচিরেই জাতীয় অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড কাজ করবে। আমাদের প্রত্যাশা-বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করবে। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন, এছাড়াও চিকিৎসকদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তন, স্বাস্থ্য বিমা, হেলথ কমিশন গঠন সময়ের দাবি। গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নত চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত হবে। মিলনের বিদেহী আত্মার শান্তিতে থাকুক এই কামনা নিরন্ত।

লেখক : উপাচার্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close