মো. জিল্লুর রহমান

  ২৬ নভেম্বর, ২০২২

মতামত

সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাই সঠিক তথ্য-উপাত্ত

সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক ও সর্বোত্তম উপায় নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্যের প্রয়োজন হয়। তথ্য ও উপাত্তের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়, তবে যে ধরনের তথ্যই হোক সেটা হতে হবে নির্ভুল, নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত।

তাত্ত্বিকভাবে পরিসংখ্যান এমন এক গাণিতিক বিজ্ঞান, যা মূলত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত। মৌলিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক এবং আরো নানা শাখায় এর বহুমাত্রিক ব্যবহার প্রচুর। উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তা থেকে তথ্যসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিসংখ্যানের ভূমিকা অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের গবেষণা ও উপস্থাপনের জন্য পরিসংখ্যানের মৌলিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তবে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পরিসংখ্যানের অপব্যবহারও হয় যত্রতত্র।

চলতি বছর ১৫ থেকে ২১ জুন দেশের ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সিলেট অঞ্চলে এ গণনা কার্যক্রম বাড়িয়ে ২৮ জুন পর্যন্ত করা হয়। এবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দ্রুত সময়ের মধ্যে গত জুলাই মাসে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। কিন্তু এ গণনা কার্যক্রমের পরপরই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অভিযোগ উঠে জনশুমারিতে অনেকে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি কিংবা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে গণনাকারীরা সবার কাছে যথাসময়ে পৌঁছেনি, ফলে অনেকে জনশুমারীর গণনায় বাদ পড়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) কে ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ফের মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে। এ সময় বিআইডিএস সারা দেশ থেকে ৩৫৪টি নমুনা এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এবারের তৃতীয় পক্ষ মূল্যায়নে দেখা গেছে শুমারিতে ৩ শতাংশ মানুষ আন্ডারকাউন্ট বা গণনার বাইরে ছিল। ফলে সে হিসাবে প্রায় ৪৯ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ বাদ পড়ে। এছাড়া শুমারিতে গণনা করা হলেও প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিদেশে অবস্থানরত প্রায় ৭০ লাখ বাংলাদেশির তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সব মিলিয়ে হিসাব ধরলে দেখা যায় দেশের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৬ জন। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার ইমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) বিভিন্ন সময়ের দেওয়া তথ্যমতে, এখন দেশের বাইরে আছেন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি। এ হিসাব ধরলে সংশ্লিষ্টরা মোট জনসংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো গণনা বা শুমারি জরিপে ২-৩ শতাংশ ভুল থাকাটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে প্রাথমিক হিসাব সমন্বয় করে চূড়ান্ত হিসাব বের করা হয়। এছাড়া মানুষ অনেক সময় আগের মূল শুমারিতে কী তথ্য দিয়েছে আর পিইসিতে কী তথ্য দিচ্ছে তার মধ্যে মিল নাও থাকতে পারে। এটাকে বলা হয় রেসপন্ডেন্ড ইরোর। আবার অনেক সময় অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনও হতে পারে। এ কারণে যেকোনো শুমারিতে আন্ডারকাউন্ট ৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। জনশুমারির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যেমন মাথাপিছু আয় নির্ধারণ, জাতীয় বাজেট প্রণয়ন, দেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ ইত্যাদি। এ কারণে সঠিক ও নির্ভুল তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

একটি পরিসংখ্যান নমুনা হলো একটি নমুনার মান থেকে গণনা করা যেকোনো পরিমাণ, যা পরিসংখ্যানগত উদ্দেশ্যে বিবেচনা করা হয়। পরিসংখ্যানগত উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে একটি জনসংখ্যার প্যারামিটার অনুমান করা, একটি নমুনা বর্ণনা করা বা একটি অনুমান মূল্যায়ন করা। পরিসংখ্যান হচ্ছে নমুনা মানের গড় (বা গড়)। প্রদত্ত নমুনার ফাংশন এবং ফাংশনের মান উভয়ের জন্যে পরিসংখ্যান শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যখন একটি পরিসংখ্যান একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি এমন একটি নাম দ্বারা নির্দেশ করা যেতে পারে, যা তার উদ্দেশ্য নির্দেশ করে।

নমুনা ডেটা সংক্ষিপ্ত করতে একটি বর্ণনামূলক পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়। পরিসংখ্যানগত হাইপোথিসিস পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি টেস্ট পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়। মনে রাখা দরকার, একটি একক পরিসংখ্যান একাধিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে- উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, নমুনা গড় জনসংখ্যার গড় অনুমান করতে, একটি নমুনা ডেটা সেট বর্ণনা করতে বা একটি অনুমান পরীক্ষা করতে পরিসংখ্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।

বাস্তবতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বে পরিসংখ্যান এমন একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান, যার ওপর ভিত্তি করে দেশ, জাতি, করপোরেট বিশ্বের যত সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পরিসংখ্যানহীন যেকোনো তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ এমনকি সিদ্ধান্তও এখন একেবারেই অচল। তথ্যউপাত্তের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে আধুনিক কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য নানা অঙ্গনেও। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে তথ্যউপাত্তের ব্যবহার ও পরিসংখ্যানের গুরুত্ব। বিশেষ করে পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য সঠিক পরিসংখ্যান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সে সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি প্রবল থাকায় সঠিক তথ্য প্রাপ্তিতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।

সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব সব সময়ই ছিল। কিন্তু এখন আরো অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। তাছাড়া জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যাই বলি, সবকিছুর সঙ্গেই তথ্যউপাত্ত জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও তথ্যউপাত্তের প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সঠিক, সময়োপযোগী এবং মানসম্মত পরিসংখ্যান প্রস্তুত করে দেশের পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জনশুমারি, কৃষিশুমারি, অর্থনৈতিক শুমারিসহ বিভিন্ন প্রকার সার্ভে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করে থাকে বিবিএস। তবে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অনুমানের বেড়াজাল থেকে পরিসংখ্যানকে বের করে আনা বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং দিকদর্শনের জন্য যা অপরিহার্য। সুষ্ঠু পরিসংখ্যানই নিরসন করতে পারে ফসল উৎপাদন, আমদানি কিংবা রপ্তানিসহ বহু কাজের বিদ্যমান বিভ্রান্তি বা বিব্রতকর পরিস্থিতি। কৃষক থেকে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এখনো রয়েছে পরিসংখ্যানের ওপর আস্থার শঙ্কা ও সংকট। এর দ্রুত অবসান ঘটানো প্রয়োজন।

প্রাচীনকালে পরিসংখ্যানের ব্যবহার শুধু রাষ্ট্রীয় কার্যাদি পরিচালনার মধ্যে সীমিত থাকলেও বর্তমানে এর ব্যবহার মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি পরিসংখ্যানের বিভিন্ন কলা-কৌশলকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহারের দ্বার উন্মোচন করেছে। আস্থানির্ভর পরিসংখ্যান যেমন রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে ভিত্তিরূপে ব্যবহার জরুরি, তেমনি সাধারণ কৃষকের কাছেও খনার বচনের মতো গুরুত্ববহ। বস্তুনিষ্ঠ কৃষি পরিসংখ্যান যেন দেশের এবং কৃষকের জন্য খনার বচনের উপমায় সমহারে নিত্যপালনীয় ও পাথেয় হয়ে ওঠে, সেটাই প্রত্যাশা।

দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ তথ্যউপাত্তের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব খাতে পরিসংখ্যানের তথ্যউপাত্তের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরো বাড়বে। টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী তথ্যউপাত্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যউপাত্তের গুরুত্ব সবসময়ই ছিল। কিন্তু এখন আরো অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বুঝতে হলে সঠিক তথ্যউপাত্তের বিকল্প নেই। তা ছাড়া, জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যা-ই বলেন, সবকিছুর সঙ্গেই তথ্যউপাত্ত জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখন বিশ্বব্যাপী তথ্যউপাত্ত যাচাই-বাছাই ও গবেষণা করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়।

সব খাতে তথ্যউপাত্তের প্রয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। নির্ভরযোগ্য তথ্যউপাত্তের গবেষণা উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপক। আর্থ সামাজিক সব কর্মকান্ডের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে তথ্যউপাত্তের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত সঠিক তথ্যউপাত্তই কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক, জনমিতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিমাপে তথ্যউপাত্তের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সঠিক ও মানসম্মত তথ্যউপাত্তের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত তথ্যউপাত্তের ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ তথ্যউপাত্তের প্রয়োগ দেশকে দ্রুত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

[email protected],

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close