মোরশেদুল ইসলাম

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ শামসুল হক : প্রান্তিক এক সাহিত্যিকের নাম!

‘জন্মে জন্মে বারবার কবি হয়ে ফিরে আসব এই বাংলায়।’ (বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা থেকে)

এই যার আশা ছিল তার নাম সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক হিসেবে তাকে চিনি আমরা। নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, গান, চিত্রনাট্যসহ সাহিত্যের সব শাখায় রয়েছে তার সাবলীল পদচারণা, যা আর কোনো বাংলাদেশির নেই। প্রায় ৬২ বছরব্যাপী বিস্তৃত ছিল তার বহুমাত্রিক লেখক জীবন।

১৯৬৬ সালের কথা বলছি। মাত্র ৩১ বছর বয়সে স্বৈরাচার ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমলে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন তিনি। ভাবা যায়! তিনি কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকগোষ্ঠীর ধামাধরা ছিলেন না। তবু তারা তাকে পুরস্কার দিতে বাধ্য হয়েছিল শুধু তার প্রখর মেধার কারণে। তার ধারালো কলমের ওজনের কারণে। এবং আরো চমকপ্রদ ব্যাপার হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন! স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক কিংবা অন্যান্য পুরস্কারের কথা বাদই দিলাম। তবু কোথাও যেন একটা সমস্যা রয়েই গেছে! সর্বসাধারণ্যে বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যথাযথভাবে আলোচিত হওয়ার অভাব, পঠিত হওয়ার অভাব। তার জন্ম ও প্রয়াণ দিবস এলেই সেটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড কষ্ট লাগে যখন দেখি এত বড় একজন কৃতী ব্যক্তিকে নিয়ে চোখে পড়ার মতো তেমন বিশেষ কোনো আয়োজন নেই, উৎসব নেই, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয় না! নামকাওয়াস্তে কিংবা দায়সারাভাবে একটু-আধটু আলোচনা হলেও যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয় না, বরং আমরা করি না। ঢাকঢোল পেটানো তো দূরের কথা। ‘লোকে ভোলে ভুলে যাক, তুমি যেন ভুলো না সে কথা,/তোমারই সময়-কথা আমিও তো বলেছি ভাষায়,/তোমারই ভাষায়, মা গো।...’ (সৈয়দ হকের স্বরচিত সমাধিলিপি থেকে)

বস্তুত, আমরা সৈয়দ হককে বোধ হয় এখনো চিনতে পারিনি। না পেরেছি তার সৃষ্টিকর্ম ভালো করে বুঝতে। তিনি এমন একজন সাহিত্যিক যার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্য নাটকের মতো সৃষ্টি থাকার পর সাহিত্য জগতে বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো সৃষ্টিকর্মের প্রয়োজন পড়ে বলে মনে হয় না। কিংবা এক নূরলদীনের সারা জীবন, পরাণের গহিন ভেতর, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা, নিষিদ্ধ লোবান, নীল দংশন, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, এখানে এখন, জলেশ্বরীর গল্পগুলো, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, দেয়ালের দেশ, খেলারাম খেলে যা, মার্জিনে মন্তব্য প্রভৃতি সাহিত্যকর্মের কথা ভাবুন। এমন সব ক্ল্যাসিক সাহিত্যকর্ম থাকার পরও তাকে নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ্যের মাঝে কিংবা সাহিত্যসমাজে, কথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করে, যা একজন সাহিত্যসচেতন পাঠককে না ভাবিয়ে পারে না। তার লেখায় যে বাঙালি সংস্কৃতি চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনা তা একজন সাধারণ পাঠকও খোলা চোখে দেখতে পারে। বুঝতে পারে। যে লোকটা শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বাংলাভাষীর জন্য গৌরবের তার প্রতি কেন এত অনাগ্রহ, অনাদর, কেন এত অবহেলা? অথচ বাংলাদেশবিরোধী চেতনা লালনকারী অনেকের বেলাতেই দেখা যায় বর্ণিল চিত্র! এজন্যই হয়তো হক সাহেব লিখে গেছেন : ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;/নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়/ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।...’

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে তিনি বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকরিরত ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি তিনিই পাঠ করেছিলেন।

বেশি গভীরে যাব না। শুধু একটা উদাহরণ দিই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের এক বৃষ্টিভেজা দিন। কাঠের কফিনে করে, বালু দিয়ে নিচু জমি ভরাট করে তাকে কবরস্থ করা হয়েছিল। কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের এক প্রান্তে। শুনেছিলাম সেখানে শিগগিরই একটি সমাধিসৌধ হবে। হবে একটি কমপ্লেক্স। যার নাম হবে জলেশ্বরী কমপ্লেক্স। সেখানে থাকবে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, মিলনায়তন, অফিস, মুক্তমঞ্চ ইত্যাদি ইত্যাদি! সময় বয়ে চলে। কত-শত রথী-মহারথী আসেন, কিন্তু শোনা কথা শব্দের মতোই থেকে যায় অদৃশ্য! এবং দুঃখজনকভাবে এই সব্যসাচী সাহিত্যস্রষ্টাও হতে থাকেন আক্ষরিক অর্থেই প্রান্তিক!

কিছুদিন আগে শুনলাম চারুলিপি প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী প্রিয়জন হুমায়ূন কবির ভাইয়ের বিশেষ আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় কবিপত্নী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সমাধিসৌধ ও প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলতে। এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নাকি প্রায় ৫০ কোটি টাকার একটি খসড়া প্রকল্প তৈরিও করেছে। আল্লাহ মালুম, কোথায়, কোন রঙের ফিতায় সেই প্রকল্পের ফাইল বন্দিজীবন কাটাচ্ছে!

এবার একটা ভিন্ন গল্প বলি। সৈয়দ হকের প্রায় বইগুলোর শেষ ফ্লাপে তার পরিচয়ের মধ্যখানে লেখা থাকে, ‘পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে’। অনেক সময়ই আমার খটকা লাগত। ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। এরই মধ্যে এক দিন তার স্ত্রী সৈয়দ আনোয়ারা হকের একটা স্মৃতিচারণমূলক রচনায় (সেদিন দুজনে, সমকালে প্রকাশিত) পড়লাম, তাদের প্রথম অভিসারের গল্প। সেখানে হক সাহেব বলছেন : ‘আমি কিন্তু শুধু আইএ পাস। লেখাপড়া করিনি। ভালো লাগেনি বলে।’ যেন আকাশ থেকে পড়ার দশা আমার। ব্যাটা কয় কী! আরো ভালো করে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলাম। হাতে পেলাম ৩০ আগস্ট, ২০১৩ সালে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সব্যসাচীর একটা সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার শুরু হওয়ার আগে মোটা মোটা হরফে লেখা ছিল :

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সৈয়দ শামসুল হককে এক দিন মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্ট’র ওপর একটা লেখা লিখতে বলা হলো। সে কোনো সূত্র বা উদ্ধৃতি ছাড়াই লেখাটা লিখেছিল। তার অধ্যাপক সেটা পছন্দ করেননি এবং তাকে নিয়মকানুন না মেনে লেখার জন্য বকাঝকা করলেন। সে তখন শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে কিছু শেখাতে পারবে না।’ বলে চিরতরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ল। আজ সেই সৈয়দ হক এমন একজন সাহিত্যস্রষ্টা, যার সমতুল্য বাংলা সাহিত্যে যুগ যুগ ধরে দেখা যায়নি।...’

গোটা সাক্ষাৎকারটা এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। আবার পড়লাম। গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল সেদিন। আজ সেই প্রচণ্ড মেধাবী লোকটার প্রয়াণ দিবস। কজন জানেন?

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কথাশিল্পী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close