আবদুর রউফ

  ২১ নভেম্বর, ২০২১

মুক্তমত

ছাত্ররাজনীতি ও বর্তমান বাস্তবতা

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। শুধু শিক্ষার অধিকার আদায়ে নয় বরং দেশের যেকোনো সংকটে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি আজ হারাতে বসেছে। ছাত্র রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসগুলোতে অস্থিরতা- যেন তারই প্রমাণ। গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বর্তমান সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে এমবিবিএস ৬২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহাদী জে আকিব মারাত্মকভাবে আহত হন। তার মাথায় অস্ত্রোপচার করে খুলির একটি অংশ খুলে ফেলা হয়েছে। সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে সেখানে কলম দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমধ্যেমে ভাইরাল হয়ে যায়।

বুয়েটে আরবার হত্যাকা-ের পর যেমন ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়, ঠিক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঘটনার পর এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নানা মতামত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কেউবা বলছেন দলীয় স্বার্থে ছাত্র সংগঠনগুলো ব্যবহার করার মানসিকতা থেকে অভিভাবক রাজনৈতিক দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। কেউ বা আবার বলছে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে শুধু সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক দাবি-দাওয়া নিয়ে কাজ করার জন্য। তবে ছাত্ররাজনীতির অতীত ইতিহাস বলে, এ দেশে অবশ্যই ছাত্ররাজনীতি থাকা প্রয়োজন। সেই ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে শুরু করে আজ অবধি অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে দেশের ছাত্রসমাজ তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অধিকার ছিনিয়ে এনেছে। যেমনি ভাবে বহির্বিশ্বের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি, তাহলেও আমরা ছাত্রসমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে পাব। পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছাত্রসমাজ অধিকার আদায়ের জন্য যত আন্দোলন সংগ্রাম করেছে এবং ঐতিহাসিক অর্জন রয়েছে এমন গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস অন্য কোনো দেশের ছাত্র সমাজের নেই।

একপর্যায়ে এসে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির গতিপথ পাল্টাতে শুরু করে। তৎকালীন স্বৈরশাসককে এ দেশের ছাত্র-জনতা ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সেই গণতন্ত্র চর্চা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে থাকার কথা থাকলেও তা থাকেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহাবস্থান, এক ছাত্র সংগঠনকে আরেক ছাত্র সংগঠনের শ্রদ্ধাবোধ, যৌক্তিক দাবি আদায়ে কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে গেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের অভিভাবক রাজনৈতিক দলের ম্যানপাওয়ার সাপ্লায়ারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ছাত্র রাজনীতির সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়াই ছাত্র রাজনীতি।’ আর বর্তমান ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সংজ্ঞাটা হবে এমন, ‘জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে সেই দলের সমর্থন তৈরি করা, নেতৃত্ব তৈরি করা এবং সেই দলের স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করা। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি যেন যথাযথ প্রতিফলিত হচ্ছে।

আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনোটাই সম্পূর্ণ আবাসিক নয়। আর এই সুযোগে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করা ছাত্র সংগঠন ছাত্র রাজনীতির নামে হলে সিট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করা হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ধারার কিছুটা বাহিরে থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হলের সিট কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির চর্চা চলছে। ইতিপূর্বেও আমরা দেখছি ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আধিপত্য নিতে প্রথমে ক্যাম্পাসের হলগুলো দখলে নেওয়া হয়। সেখানে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন গুলোর রাজত্ব চলে। বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন এই ক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। যেহেতু হলের সিট বরাদ্দে অনেকাংশে হল প্রশাসন তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না তাই ছাত্র নেতারা ঠিক করে কে হলে সিট পাবে। সেই ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কেননা খুব সহজেই এই প্রথম বর্ষের ছেলেমেয়েদের মিছিল-মিটিং ব্যবহার করা যায়। কারণ একজন শিক্ষার্থী যখন শেষ বর্ষে বা তার পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে চলে আসে তখন তারা সেই আধিপত্য বিস্তার করা ছাত্র সংগঠনের চরিত্র বুঝে যায়। আর ক্ষমতাকে পুঁজি করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থাকে। তার ফলাফল এরই মধ্যে ক্যাম্পাসগুলো পেতে শুরু করছে। করোনার দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর, সবেমাত্র শিক্ষা কার্যক্রম একটু স্বভাবিক হতে শুরু করেছে। ঠিক তখন গ্রুপে গ্রুপে আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রনেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ঘটনার সংবাদ প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর ছাত্র রাজনীতির এমন লাজুক অবস্থা দেশের সুশীল সমাজকে ভাবাচ্ছে।

আমাদের দেশে সাধারণত যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও একদম নিম্নবিত্ত পরিবারের। যাদের অগাধ টাকা-পয়সা আছে তাদের সন্তান হয়তো দেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, নয়তো দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ক্যাম্পাসগুলোতে সেই দরিদ্রতার সুযোগে শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন ব্যবহার করছে। কোনো শিক্ষার্থী যদি কথিত ছাত্রনেতা বা বড় ভাইদের কথায় না চলে তাহলে তার ওপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন। অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, যদি তাকে হলে থাকতে হয় সেই রাজনীতির মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও সেই রাজনৈতিক দলের মিছিলে যেতে হয়। একপ্রকার যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। যদি কোনো সিনিয়র শিক্ষার্থী মিছিলে যাওয়ার অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে তাকে হল থেকে সুকৌশলে নামিয়ে দেওয়া হয়। এমন চিত্র অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের।

২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আফসানা আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তখন সেই শিক্ষার্থী তার আসবাবপত্র নিয়ে হল গেটে আমরণ অনশনে বসে। তারপর সেই ঘটনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে সেই ছাত্রীকে আবারও হলে ফেরত পাঠানো হয়। এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। কেউ প্রতিবাদ করে, আর অধিকাংশ নীরবে হল থেকে নেমে চলে যায়। এমন সংস্কৃতি চলতে থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

প্রথম বর্ষেই সব শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক কাজে ছাত্রনেতারা এমনভাবে ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে চাইলেও তারা সেই গণ্ডি থেকে বের হতে পারে না। অনেক সময় তাদের মাদক থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে অপরাধ করার অনুমতি সেই কথিত বড় ভাই বা ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। বলা হয় যা পারিস তোরা কর, কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখব। এই অভয় পাওয়ার পর সেই নবীন শিক্ষার্থী নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। একসময় চাইলেও সেই অপরাধের জগৎ থেকে সেই মেধাবী শিক্ষার্থী আর বের হতে পারে না। এভাবেই অনেক মেধাবী মুখ ছাত্র রাজনীতির মারপ্যাঁচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির এমন বেহাল দশা থেকে মুক্তির একটিই পথ, লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা থেকে বের হয়ে আসা। সেই ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। আর ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রথা চালু করতে হবে। ছাত্রদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুবই জরুরি।

এরই মধ্যে গুচ্ছপদ্ধতিতে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গুচ্ছের বাইরে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে তারাও ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অল্প কিছুদিন পরেই ক্যাম্পাসগুলো নবীন শিক্ষার্থীদের প্রচারণায় মুখরিত হবে। তাই আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় এসে স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজস্ব চিন্তায় স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির সেই অতীত গৌরব উজ্জ্বল দিনগুলো আবার ফিরে আসুক- এমনটিই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close