প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪

পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ও পতন

* বিবিসিকে এ বিষয়ে বলেছেন সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম

মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ রাজ্যে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা সিপিআইএম ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৭৭ সালে। এটি ছিল বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো কমিউনিস্ট সরকার, যারা ক্ষমতায় ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। দলটি ক্ষমতায় ছিল একটানা ২০১১ সাল পর্যন্ত। দলটির উত্থান ও পতন প্রত্যক্ষ করেছেন এই দলেরই একজন নেতা মহম্মদ সেলিম। সিপিআইএম যখন ক্ষমতায় আসে, সে সময় তিনি এই রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

সেলিম বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল, তার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরপরই লোকজন আনন্দে ফেটে পড়েছিলেন। যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেছে।

‘রাজ্যের সব এলাকায় সব রাস্তায় লালবাতি জ্বালিয়ে লোকজন উৎসব করেছিলেন। রাতারাতি কলকাতা হয়ে গেল লাল রঙের শহর’, বলেন তিনি। সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসু ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি যখন শাসন শুরু করে, তখন মহম্মদ সেলিমের বয়স ছিল ২০ বছর। সেসময় এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৭০ লাখের মতো।

যেভাবে বদলে গেল হাওয়া : সেলিম সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা স্মরণ করছিলেন। বলেন, তার কাছে যেন এটা সে দিনের ঘটনা, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। সারা রাত ধরে উৎসব চলল। বহু মানুষ যারা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন নয়, তারাও জানতে পারল- হাওয়া বদলে গেছে। নতুন কিছু এসেছে। আমার মা-ও বললেন, প্রত্যেক পাঁচ বছর পরেই তো নির্বাচন হয়, কিন্তু কী এমন ঘটেছে যে, তোমরা এভাবে উৎসব করছো? রাস্তায় এত মানুষ কেন? আমি তাকে বললাম, আমরা নতুন ধরনের স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে।

পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম ক্ষমতায় আসার দুবছর আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এর ফলে নাগরিকদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। এর জের ধরে কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। মোহাম্মদ সেলিমের মতো তরুণরা উপলব্ধি করেন, স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য তাদের এখনই উঠে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা জারি করা না হলে আমি ও আমার মতো লোকরা সম্ভবত রাজনীতিতে যোগদান করতেন না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন। এর ফলে আমাদের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে লাগল। বিরোধী নেতাকর্মীদের জেলবন্দি করা হলো এবং পুরো রাজ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি ছিল না।

কেন এই জনপ্রিয়তা : ১৯৭০ দশকে বিশ্বের অনেক দেশেই সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকায়। কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার মূলমন্ত্র ছিল বৈষম্য দূর করে সমাজের সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, যা দারিদ্র্য-পীড়িত স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে।

এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছিল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। জওহরলাল নেহরু ও মহাত্মা গান্ধীর এই রাজনৈতিক দলটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু মহম্মদ সেলিম বলেন, কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনের পর লোকজন বুঝতে পারলেন- তাদের জীবনে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

তিনি বলেন, একসময়ের সমৃদ্ধ শহর কলকাতাতেও তখন মানুষের জীবনমানের অবনতি ঘটছিল। লাখ লাখ মানুষ শুধু বেঁচে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছিল। গ্রামীণ এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীই তখন ভোটের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে।

‘কমিউনিস্ট পার্টি যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে, সাক্ষরতার হার ছিল ২৮ শতাংশ। এবং ২০১১ সালে আমরা যখন ক্ষমতা ছেড়ে দিই, সেসময় এই রাজ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ১০০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

‘বাংলায় ৩৪ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বৃহৎসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে ওপরে টেনে তোলা হয়েছিল। আমরা লোকজনকে ধনী করিনি, কিন্তু আমরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করেছি’, বলেন তিনি।

‘আমরা সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে সমগ্র বাংলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটিয়েছি, যাতে যেকোনো জায়গার ফসল বাজারে পৌঁছে যেতে পারে। এর ফলে গ্রামীণ জনগণ সম্পদশালী হতে থাকে। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে লাখ লাখ রুপি মূল্যের জমি রাতারাতি ভূমিহীন দরিদ্র শ্রমিক ও জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’

এই নীতির ফলে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকে কয়েক দশক। কিন্তু একসময়ে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা কমে যেতে শুরু করে। এবং ২০১১ সালের রাজ্য ও স্থানীয় নির্বাচনে তাদের বড় ধরনের পরাজয় ঘটে। মহম্মদ সেলিম বলেন, এই ফলাফলের ব্যাপারে তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।

‘আমি ছিলাম পার্টির সদর দপ্তরে। দুপুরের দিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এই ফলাফলই প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এই পরাজয় শুরু হয়েছিল ২০০৮ সাল থেকে।’

‘সেসময় স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল, ২০১০ সালে হয়েছিল কলকাতা পৌরসভা নির্বাচন। এই দুটো নির্বাচনেই আমাদের পরাজয় ঘটে। ফলে ইঙ্গিতটা সেখানেই ছিল।’ কিন্তু দলের এই সমস্যা সমাধানে তখন কী কিছু করা হয়েছিল?

তিনি বলেন, ৩৪ বছর ধরে কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে, ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই কমতে শুরু করে। এই দীর্ঘ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ কমতে থাকে। আমাদের পরাজয়ের পেছনে কিছু রাজনৈতিক ত্রুটিরও ভূমিকা ছিল। আমরা শিল্পায়নের পথে গিয়েছিলাম, যা অপরিহার্য ছিল। আমরা তখন গ্রামীণ কৃষিখাতে কিছু সংস্কার হাতে নিই। কারণ শিল্প ছাড়া, আধুনিক ও বৃহৎ শিল্প ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারব না‘, বলেন তিনি।

রাজনৈতিক পরিক্রমায় সিপিআইমের এসব ভুল কি ধরা পড়েছিল? তিনি কি সেগুলো দেখতে পেয়েছিলেন?

‘আপনি যখন বিশেষ কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে যাবেন, বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটাবেন, এজন্য জনগণকেও প্রস্তুত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে- তাদের ভালোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু তখন এসবের বিরোধিতায় সবাই একত্রিত হয়েছিল।’

তিনি আরো বলেন, আমরা যা করতে চেয়েছিলাম এবং আমরা যা করেছি, সেগুলো ঠিকমতো প্রচার করা হয়নি। কিন্তু বিরোধীরা কমিউনিস্টদের ব্যাপারে জনগণের সামনে যেসব সমালোচনা তুলে ধরলেন সেগুলো জনপ্রিয়তা পেল।

‘বিরোধীরা বলল যে, কমিউনিস্টরা সহিংস দল, তারা চীনের এজেন্ট, তারা রাশিয়ার এজেন্ট অথবা তারা ধর্মের বিরোধী, জাতপাতের বিরোধী। ভারতের মতো একটি দেশে লোকজন এসব বিষয়ে খুব আবেগপ্রবণ। ফলে একটা বিভাজনের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামনে চলে এলো। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এসব যুদ্ধে হেরে গেছি’, বলেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেন, কংগ্রেস এবং বিজেপি- এই দুটো দলই এসব ইস্যু ব্যবহার করল। ফলে লোকজন জমি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এসব বিষয়ের পরিবর্তে মন্দির ও মসজিদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। রাজনীতির পুরো বিষয়টিই তখন বদলে গেল। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ভবিষ্যৎ : বিশ্বে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি কি কোনো শিক্ষা নিয়েছে? আগামীতে তারা কি কখনো ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে?

মহম্মদ সেলিমের উত্তর, আমাদের নেতা ও সমর্থকদের একটি বিশাল অংশ এই পরাজয় বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সরকার যখন বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে চাইল, লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হলো, শিল্পায়ন ঘটাতে চেষ্টা করল, তখনই এই সরকার পরাজিত হলো। কিন্তু যারা শিল্পায়নের বিরোধিতা করল, যারা কলকারখানা ধ্বংস করে দিল, তারাই নির্বাচিত হলো।

তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এখন কাস্তে-হাতুড়ি-তারার (সিপিআইএমের নির্বাচনী প্রতীক) ভবিষ্যৎ কী?

মহম্মদ সেলিম বলেন, হাতুড়ি ও কাস্তে লোহা দিয়ে তৈরি। এবং এই দুটো কর্মজীবী মানুষের হাতিয়ার। ফলে যতদিন কৃষকরা থাকবেন, ততদিন তাদের এই কাস্তের প্রয়োজন। যতদিন শ্রমিকরা থাকবেন, ততদিন তাদের হাতুড়ির দরকার। আমরা ক্রমশই আন্দোলন গড়ে তুলছি, তরুণদের বিশাল একটি দল হাতে লাল পতাকা এবং কাঁধে কাস্তে ও হাতুড়ির প্রতীক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close