বিশেষ প্রতিনিধি

  ২৪ জুলাই, ২০১৭

নির্বাচনী রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই সরগরম হয়ে উঠছে নির্বাচনী রাজনীতি। নির্বাচনী আলোচনায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। সামনে আসছে নানা মত ও প্রস্তাব। নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ছে; তেমনি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশাও দেখছে মানুষ। সরকার চাইছে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠানে চূড়ান্ত রোডম্যাপ নিয়ে মাঠে নির্বাচন কমিশন। মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে—নির্বাচনী অঙ্ক কষতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে নির্বাচনী রাজনীতিতে এই মুহূর্তে আস্থা-অনাস্থা দুটোই চলছে সমানতালে।

তবে নির্বাচনকে ঘিরে এখনো পরস্পরের প্রতি আস্থা আনতে পারছে না প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও তাদের শরিকরা। নিজ নিজ দাবি ও সিদ্ধান্তের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান তাদের। বরং গত কয়েকদিনে নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন কিছু ইস্যু যুক্ত হয়েছে। বেড়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস-অনাস্থা। উত্তাপও বেড়েছে রাজনীতিতে। বিশেষ করে সর্বশেষ ইসির রোডম্যাপ ঘোষণা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে দেশে এখন চলছে নানা সমালোচনা-আলোচনা। খালেদার লন্ডন সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি দলীয় শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন মামলায় সাজার ভয়ে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে, খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে রেখে সরকারের একতরফা নির্বাচনের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে বিএনপিও। প্রতিদিনই এ নিয়ে বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অভিমত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যেহেতু নির্বাচন নিয়ে এখনো বড় দুই দল মুখোমুখি অবস্থানে। আস্থা-অনাস্থা দুটোই রয়েছে। তবে এতটা হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সবাই মিলে চাইলে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, যেহেতু বর্তমানে সংবিধানে সহায়ক সরকার বলে কিছু নেই, তাই বর্তমান সরকারের অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। তবে নির্বাচনে যেন সরকার কোন ধরনের প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য ইসিকে শক্তিশালী হতে হবে, নিরপেক্ষ ও নির্ভীকভাবে কাজ করতে হবে। যদি সেটা পারে, তা হলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে সমস্যা নেই। সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে। জোর জবরদস্তি করে, বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্বাচনে জয় পাওয়ার বাসনা দূর করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের উচিত হবে এ ব্যাপারে ইসিকে সহযোগিতা করা। তাহলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। আর বিএনপিকেও সেই আস্থা নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাত্র দেড় বছর বাকি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে এই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। গত ১৬ জুলাই চূড়ান্ত নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ৩১ জুলাই শুরু হচ্ছে নির্বাচনী সংলাপ। সেখানে ইসি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকে ঘিরে তাদের নানা অভিযোগ ও পরামর্শ তুলে ধরবে।

নির্বাচনী রাজনীতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিএনপি এখনো সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে অনঢ়। খালেদা জিয়া দেশে ফিরলেই সহায়ক সরকারের ফর্মুলা দেবে দলটি। এর মধ্যে দলীয় সভাপতির পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার অথবা বিশিষ্ট একজন নাগরিকের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের পরামর্শসহ একাধিক প্রস্তাব থাকছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে তাদের মূল ভয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় সহায়ক সরকারের বিকল্প প্রস্তাবে নির্বাচনকালে প্রধানমন্ত্রীকে ছুটিতে যাওয়ার প্রস্তাবও থাকছে। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই কোনো না কোনো পথে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনাকে সরে দাঁড়াতে হবে।

কিন্তু বিএনপির এ প্রস্তাবকে অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক বলছে আওয়ামী লীগ। দলের মতে, নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার সহায়ক সরকার হিসেবেই থাকছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তিনি শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবেন। কোনো প্রকল্প উদ্বোধন ও নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কিংবা সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তখন ইসির অধীনে থাকবে। তাই সে সময় যে সরকার থাকবে সেই সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ভূমিকা থাকবে না। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নির্বাচনকালীন তিন মাসে সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ করে নির্বাচন তদারকি কাজে নিয়োজিত জেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়ন নির্বাচন কমিশনের ওপরই ন্যস্ত থাকে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে না। সুতরাং, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো ভয় বা আশঙ্কা নেই।

এমন অবস্থায় গত ১৫ জুলাই খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরে যাওয়া নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে কিছু ইস্যু নতুন করে যুক্ত হয়েছে। লন্ডন যাওয়ার পরপরই গত সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, দেশে যাতে নির্বাচন না হয় সে লক্ষ্যে একটি চক্র চক্রান্ত করছে। সভায় তিনি এসব ষড়যন্ত্র নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার ও সতর্কভাবে কথা বলার নির্দেশ দেন। খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার একদিন পরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মামলার ভয়ে খালেদা জিয়া পালিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। তিনি এমনও বলেন, বিদেশে বসে শেখ হাসিনাকে হটানোর ষড়যন্ত্র সফল হবে না। কিন্তু বিএনপি দাবি করছে, খালেদা জিয়া যাতে দেশে ফিরতে ও নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে জন্য সরকার ষড়যন্ত্র করছে। গতকাল এর পাল্টা জবাবে বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে ‘ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার’ চিন্তা আওয়ামী লীগের নেই বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতে, বিএনপির লন্ডন কেন্দ্র, অর্থাৎ দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা-পুত্র তারেক রহমানের থেকে প্রতিবারই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত আসে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন ও ২০১৫ সালে সহিংস কর্মসূচির সিদ্ধান্তও লন্ডন থেকে এসেছিল বলে তার ধারণা। সুতরাং, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ ও জোট শরিকদের প্রস্তুতি রাখার পক্ষে তিনি। তবে প্রবীণ সাংবাদিক কাজী সিরাজের মতে, বিএনপিসহ সব দলেরই উচিত হবে বিদেশিদের কাছে ধরনা না দিয়ে দেশের ভেতর ঝগড়া-বিবাদ, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই নির্বাচনী সংকটের সমাধান করা।

ইসির রোডম্যাপও নির্বাচনী রাজনীতিকে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগ রোডম্যাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও বিএনপি একে দেখছে সরকারকে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ হিসেবে। অবশ্য এ ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও অগ্রগতি দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ১৬ জুলাই চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই রোডম্যাপটা তৈরিই করা হয়েছে সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চায়, তাকে সাহায্য করার জন্য। সুতরাং আমরা মনে করি, এখনকার বাস্তবতায় সকল দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। অবশ্য রোডম্যাপ নিয়ে এই মুহূর্তে সমালোচনা করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য নির্বাচন বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, ইসি চাইলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এবং সে নির্বাচনের সব ফর্মুলাই রোডম্যাপে রয়েছে। ফলে ইসির প্রতি আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যেতে পারে।

তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন করে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ার খবরটি। গত ১৩ জুলাই রাতে উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসভবনে ডান ও বাম ঘরানার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বৈঠক করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ার। এ নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবনায় পড়ে সরকার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে অংশ নিতেই এমন শক্তি গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য কি না; নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে- তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিশেষ করে এই জোট-সংক্রান্ত ঘরোয়া আলোচনায় পুলিশের বাধাকে কেন্দ্র করে বিএনিপি নেতাদের প্রতিবাদ ও জোটের পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন জানানোয় প্রশ্ন উঠেছে এমন জোট গঠনের নেপথ্য কারণ নিয়েও। আওয়ামী লীগ এই জোটকে আমলে না নিলেও সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছে। অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গড়ার উদ্যোগকে ভালো চোখেই দেখছেন।

পিডিএসও/হেলাল​

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংসদ নির্বাচন,রাজনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist