গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৩ জুন, ২০১৭

সীমানা পুনর্বিন্যাসে বিতর্কের মুখে ইসি

পুরনো ও অনাপত্তিযোগ্য সীমানা পুনর্বিন্যাস আইনে সংশোধনী আনতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়তে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে এ ইস্যুতে বর্তমান কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনায় বিদ্ধ হতে পারে। আর এমনটি হতে পারে বলে মনে করছেন খোদ সাবেক নির্বাচন কমিশন এবং বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, সীমানায় পরিবর্তন হলে বিদ্যমান আইনের আলোকে প্রশাসনিক অখণ্ডতা, জনসংখ্যা এবং যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে করা সমীচীন। সেটা সম্ভব না হলে ২০০৮ সালে প্রণীত সীমানার বিন্যাস বাতিল করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াটা যৌক্তিক হবে। অন্যথায়, আইন সংশোধন করে ভোটার সংখ্যানুপাতে সীমানা পুনর্বন্টন করতে হলে নতুন করে বির্তকের মুখে পড়তে পারে এই কমিশন।

সূত্র জানিয়েছে, আরপিওর ৯১(ই) ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কমিশন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ. সুশীলসমাজ কিংবা দেশের সাধারণ মানুষ তাদের ওই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে রকিবউদ্দীন কমিশনের পদে টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পরে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করার পর ৯১(ই) ধারাটি অক্ষুণ্ন রাখা হয়। এরও আগে ১/১১ ড. শামসুল হুদার কমিশন এই বিধানটি আরপিওতে সংযোজন করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়েছিলেন।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে নতুন কমিশন হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিয়োগ দেন খান মো. নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশনকে। ঈদের পরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। নির্বাচনী আইনবিধি সংস্কার করার পাশাপাশি সীমানা পুনর্বিন্যাসসহ নানা ইস্যুতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণবিষয়ক সময়সীমা বেঁধে দেবে ইসি। আর আগস্টের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি নীতিমালাও প্রণয়নের কথা রয়েছে। সেই আলোকে আগামী বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ হবে। তবে সীমানা পুনর্বিন্যাস আইন ১৯৭৬ সালের ডি লিমিটেশন অ্যাক্ট আইনে সংশোধনী এনে আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে ইসি। এ নিয়েই শুরু হয়ে গেছে আগামী জাতীয় সংসদ কেন্দ্র করে বির্তক। এর আগে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) না ডিজিটাল ভোটিং মেশিন (ডিভিএম) ব্যবহার করে সংসদ নির্বাচন করা হবে সে নিয়ে একদফা বির্তক হয়ে গেছে। এ নিয়ে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই প্রযুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিলেও ক্ষমতাসীনরা ছিলেন তার বাইরে। সে সব বির্তকের অবসান ঘটেছে একাদশ নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে।

এদিকে, বিদ্যমান সীমানা আইন সংশোধন করে জনসংখ্যা নয়, ভোটার অনুপাতে আসন পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যে বির্তক শুরু হয়েছে। কমিশনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগেই পুরনো সীমানা পুনর্বিন্যাসে ফিরে যেতে বিএনপির নেতারা গত ১৮ জুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান. মো. নুরুল হুদা কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাত করে আপত্তি জানিয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ এ বিষয়ে বলেন, ১/১১ সময় ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়। ১৩৩ আসনে ব্যাপকভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়। এই বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়েছে। সীমানা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে সরকারকে চাপে রাখতে ইসির প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এক পক্ষের (বিএনপি) কথা শুনেছি। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলব। এরপর সীমানা নির্ধারণে জটিলতা দূর করে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হবে। সরকারকে চাপে রাখা প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, এটা ইসির কাজ নয়। ইসি আইন অনুযায়ী কাজ করবে।

তবে, গত ২০ জুন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি প্রতিনিধিদল ইসির সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনে কোন কোন বিষয়ে সহায়তা দিতে সম্মত রয়েছে সে-সংক্রান্ত একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সীমানা বিন্যাস কিভাবে করা হবে সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেন। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সীমানা ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারণ করা হবে। ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সিইসি বলেন, মূলত শহর এলাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে অল্প এলাকায় বেশি সংখ্যাক নির্বাচনী আসন বরাদ্দ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রামে বসতি কমে যাওয়ায় শহরে বিরাট এলাকা নিয়ে সংসদীয় আসন হচ্ছে। এতে গ্রামের জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে কমিশন ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে আসনবিন্যাস করতে চায়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জনসংখ্যার বদলে ভোটার সংখ্যার অনুপাতে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হলে সমস্যা হবে না, কঠিন সমস্যা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে তাদের আগের কমিশন যে সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন তা আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি তাই পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। পরে দেখেছি বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাইছে না তখন সীমানা পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি। যদি বিএনপি নির্বাচনে আসত তাহলে বিন্যাসের প্রয়োজন হতো। তিনি বলেন, আমি শুনেছি বর্তমান কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, ভোটারভিত্তিতে সীমানা করতে চাচ্ছেন। তবে সেটি করতে হলে প্রশাসনিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। কারণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আঞ্চলিক অখণ্ডতা নষ্ট হয়েছিল। এবার অখণ্ডতা বজায় রাখতে হলে দুটি উপজেলা নিয়ে একটি সংসদীয় আসন করতে হবে।

১/১১ সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমান কমিশনের চিন্তা বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে কমিশন ফেঁসে যেতে পারে। জনপ্রতিনিধি হন জনগণের। একজন জনপ্রতিনিধি কেবল ভোটারের কাছে দায়বদ্ধ নন। এ কারণে পৃথিবীর সব দেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশন এখন যদি আইন পরিবর্তন করে এটা করতে চায়, তাহলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কমিশনের বিরুদ্ধে মামলাও হতে পারে।

সু-শাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একেক কমিশন আসেন আর নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেন। ড. শামসুল হুদা কমিশন কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ইভিএম প্রবর্তন করলেন এবং ঘরে বসে সীমানার পুনর্বিন্যাস করে গেলেন। পরের কমিশন রকিবউদ্দিন সাহেবরা এসে ইভিএম বাতিল করলেন এবং প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতাসংক্রান্ত ধারা ৯১(ই) বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু বির্তকের মুখে পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এবার খান মো. নুরুল হুদা কমিশন চাইছেন চিরায়ত জনসখ্যার পরিবর্তে ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণের। সামনে-পেছনে কিছু না ভেবে হুট করে এক-একটি সিদ্ধান্তের কারণে বিতর্কের মুখে পড়ে কমিশন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। নতুন করে আইনে পরিবর্তন না এনে বরং ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ায় শ্রেয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নির্বাচন কমিশন,ইসি,সীমানা পুনর্বিন্যাস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist