জাহিদুল ইসলাম

  ২৩ মার্চ, ২০২৩

রমজানে বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তা

দেশের বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। সে অনুযায়ী বাড়েনি আয়। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। এর মধ্যেই এসেছে সিয়াম সাধনার মাস। তবে বাংলাদেশে পবিত্র রমজান মাস মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য দুশ্চিন্তা নিয়ে এসেছে। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে তারা কী দিয়ে কী করবেন ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না।

অনেকের সঙ্গেই কথা বলে যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে মন্দা পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মধ্য ও নিম্নবিত্তের। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই দেশে সরকার অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়ায়। ফলে পণ্য আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে বেড়ে যায় পরিবহন ব্যয়। এর প্রভাব পড়ে পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপরও। ফলে খাদ্যসামগ্রী, পোশাক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর মূল্যই বেড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে এসেছে পবিত্র রমজান মাস। করোনা পূর্ববর্তী রমজান মাসে দেখা গেছে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চিনি, তেল, ছোলা, মসুর, মুড়ি, ডাল, পেঁয়াজ, খেজুরসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন অধিক মুনাফার আশায়।

গত ১৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে হবিগঞ্জের দিনমজুর জমির আলীর মন্তব্য ছাপানো হয়, যেখানে তিনি বলেছেন, পেটে পাথরবান্ধা ছাড়া কোনো গতি নেই। কারণ তিনি এক দিন কাজ করলে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা (যদিও অন্যরা জানান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা) পর্যন্ত মজুরি পান। কিন্তু কম দামের মোটা চালও এখন ৫৫-৬০ টাকায় কিনতে হয়। এছাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস আছে। ফলে এবার মাহে রমজানে জমির আলীর মতো অনেকেই আছেন দুশ্চিন্তায়। সারা দিন রোজা রাখার পর কীভাবে ইফতারি করবেন, রাতের খাবার আর সাহরি করবেন তাই নিয়ে তিনি ভাবছেন।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের একটি বিজ্ঞাপন ভাইরাল হয়, যেখানে এক অসহায় বাবা অনুরোধ জানিয়েছেন তার একটি কিডনি বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে। কিডনি বিক্রির অর্থ দিয়ে তিনি ও তার তিন সন্তানের বেঁচে থাকার আকুতি।

সাম্প্রতিক বাজারদর নিয়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ফার্মের বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৮ টাকায়, যা গত বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি। আবার খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। এক্ষেত্রে ৪০ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে। আপেল গত বছর ছিল ১৮০ টাকা কেজি, সেটা ২৭ শতাংশ বেড়ে এখন ২৩০ টাকা। সরু বোরো চাল যেটা গত বছর এই সময়ে ছিল ৬২ টাকা কেজি তা এখন ৭৪-৭৬ টাকা। চিনি ছিল ৭৯ টাকা, এখন ১১৫-১২০ টাকা। অথচ সরকার ঘোষণা দিয়েছে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৭ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকায় বিক্রির। ব্রয়লার মুরগি ছিল ১৫৮ টাকা কেজি, যা এখন ২৫০-২৬০ টাকা। অবশ্য গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে ২৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বেশি দামের বিষয়ে বিক্রেতারা জানান, সরবরাহ কমে গেছে তাই এ অবস্থা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, অসাধু চক্র বা বাজার সিন্ডিকেট এই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বড় বড় কোম্পানি ও আড়তদার-মজুতদাররাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার মূল্য। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার গণমাধ্যমকে জানান, খাদ্য ও বাচ্চার মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছুটা দাম বাড়তে পারে কিন্তু এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে তা মাত্রাতিরিক্ত। এত বেশি দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হলেও প্রান্তিক খামারিরা বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। এ মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে করপোরেট কোম্পানিগুলো। তারা প্রতিদিনের দাম নির্ধারণ করেন। বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।

এদিকে গত বছরে যে আলু প্রতি কেজি ১৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা এখন বেড়ে ২০-২২ টাকা হয়েছে। বছরজুড়ে যে ছোলার দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে রমজানের কয়েক দিন আগে থেকেই সেই ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজিতে। গত বছর মরিয়ম খেজুর ৫ কেজির প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় অথচ এবার সেই খেজুরের দাম হাঁকানো হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া মধ্যম মানের ফরিদা জাতের খেজুর গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে, যা এবার সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী খেজুর নেই। সাধারণত রমজানে ৫০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকে কিন্তু এখন পর্যন্ত মজুদ আছে মাত্র ২২ হাজার টন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত জানুয়ারিতে ২৯ হাজার টন খেজুর আমদানির জন্য এলসি খোলা হলেও এখন পর্যন্ত তা এসে পৌঁছায়নি।

তবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত বলছেন, দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। মাহে রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ফলে সংকট না থাকায় রমজানে এবার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না। বরং রোজার শুরুতেই চিনি, ছোলাসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম কমতে পারে।

গত ১৯ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির ষষ্ঠ সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে নিত্যপণ্য মজুদ রয়েছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও ছোলার পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি হয়েছে। এ কারণে রমজান সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের দাম আর বাড়বে না। তবে এক সঙ্গে বেশি করে পণ্য ক্রয় করে বাজারে চাপ সৃষ্টি করার কোনো প্রয়োজন নেই। বাজারে কঠোর নজরদারি করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়াবে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করবে সরকার।

এদিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীতে প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন রমজানে কোনভাবেই মাছ-মাংসের দাম বাড়বে না। এমনকি দাম নির্ধারণ করে দেওয়াসহ ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এক পর্যালোচনামূলক সভা শেষে বলেছিলেন, রমজানে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও পণ্য সরবরাহ আছে, তাই দাম বৃদ্ধির কারণ নেই। আবার গত ১৩ মার্চ রমজানে বাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে জেলা প্রশাসকদের আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। এছাড়া গত ১৪ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তরে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি মূল্যবৃদ্ধি বা খাদ্য সংকটের গুজব ছড়ালেও সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল।

এদিকে দাম স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে নিয়মিত বাজারে অভিযান চালাচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স। কিন্তু সরকারের এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ব্যবসায়ীদের কাছে কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসন ব্যবস্থা।

পিডিএস/মীর

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দুশ্চিন্তা,রমজান,বাজার
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close