গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৭ মে, ২০২১

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত

সংক্রমণ ছড়াবে এলাকা থেকে এলাকায়

নভেল করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ থামাতে সরকারের আরোপ করা ‘বিধিনিষেধ’ আংশিক কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও কিছু সুফল পাচ্ছে দেশ। হাসপাতালে রোগীর চাপ কমেছে। নতুন সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও কমে আসতে শুরু করেছে। তিন সপ্তাহ পর দেশে এক দিনে ৬০ জনের কম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় গত ৩০ এপ্রিল। সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪১ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তবে ভারতে ছড়িয়ে পড়া কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন এবং দেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের উদাসীনতা এখনো উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। তার ওপর নগর ও জেলার ভেতরে গণপরিবহন চলাচল করার সুযোগ দেওয়ায় নির্দিষ্ট জেলা বা মহানগরের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, যে পর্যন্ত বিধিনিষেধ জারি আছে, সেসময় পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ রাখলে এর সুফল মিলত। গত বছর ঈদযাত্রায় গণপরিবহন খুলে দেওয়ায় সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেছেন, ‘ঈদের আগে গণপরিবহন চালু করাটা করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এই উৎসবের আগে গণপরিবহন চালু করা ঠিক হয়নি। সরকারের ঘোষিত ১৬ মে পর্যন্ত যে লকডাউন ওই পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ রাখা উচিত ছিল। কারণ গণপরিবহনে সবচেয়ে ঝুঁকির বিষয় হলো সংক্রমণটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিয়ে যায়। আক্রান্ত এলাকা থেকে যদি কেউ সংক্রমণ নিয়ে বাসের অন্য যাত্রীদের মধ্যে এটা ছড়িয়ে দিতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে কয়েক কোটি লোক বাস করে। এসব লোকের মধ্যে যারা সংক্রমিত (হয়তো তারা জানে না অর্থাৎ উপসর্গহীন) তারা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। আমরা লকডাউনের যে সুফল পাচ্ছিলাম এত দিন; গণপরিবহন চালু করায় এটা অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে কতগুলো অতি-সংক্রামক জায়গা বা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রধানত একটি হচ্ছে গণপরিবহন। গণপরিবহন ছাড়াও শপিং মল, জনসভা এবং গণজমায়েতও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে একদিকে লকডাউন বজায় রাখা হলো এবং অন্যদিকে এগুলো খুলে দেওয়া হলো এরমধ্যে দিয়ে অর্জনটা ম্লান হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘করোনাকে যতটা সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম; সেই জায়গা থেকে আমরা সরে গেলাম। অর্থাৎ করোনা বিস্তৃত হতেই থাকবে।’

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আসন্ন ঈদ উপলক্ষে বড় শহর থেকে অনেকে ভেঙে ভেঙে গ্রামে যাবেন। এই যাওয়ার মধ্য দিয়ে বড় শহর থেকে ভাইরাসটা গ্রামে বহন করে নিয়ে যাবেন তারা। ফলে রোগটি আবার ছড়িয়ে পড়বে। আমরা দেখেছি, গত বছর ঈদের আগে গণপরিবহন চালুর কারণে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল। রোগীর সংখ্যা বেড়েছিল। এবারও সে রকম আশঙ্কা করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে সব ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি এবং গণপরিবহন বন্ধ রাখা উচিত। তা না হলে যার গাড়ি আছে, সে বাড়ি যেতে পারবে; যার নেই সে যেতে পারবে না। এতে মানুষজন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তাই ঈদ ঘিরে সব পরিবহন ৭ দিনের জন্য বন্ধ রাখা হোক।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘গণপরিবহন অবশ্যই ঝুঁকিপুর্ণ। কারণ এটাতে মানুষ গায়ে গায়ে লেগে চলে। গণপরিবহনে দুই সিটে একজন বসবেন এটা বলা যাবে না। তাই গণপরিবহনের সংকট যতখানি দূর করা যায় চেষ্টা করতে হবে। যুবক ও সক্ষম মানুষকে বলতে হবে আপনারা ত্যাগ স্বীকার করে হেঁটে গন্তব্যে যান। পাশাপাশি বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং নারী-শিশুদের গণপরিবহন সুবিধা দিতে হবে। এরপরও অবশ্যই একটা ঝুঁকি থেকে যায়, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর করোনা তো আজকেই চলে যাচ্ছে না। আবার গণপরিবহন বন্ধ রাখাও যায় না। তাই সরকার, পরিবহন সংগঠনের নেতা-মালিক এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞরা একত্রে বসে গণপরিবহন ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারে। আবার অতিরিক্ত বাড়িয়ে ট্রাফিক জ্যাম বাড়ানো যাবে না। আবার গণপরিবহনের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ রিকশা, মোটরসাইকেল, অটোরিকশাগুলোর নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে; যাতে মানুষের প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরতে পারে।’

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আগামী ১৬ মে পর্যন্ত যদি গণপরিবহন বন্ধ রাখতাম, সেটা ভালো হতো। পাশাপাশি এ সময়ে যদি বাসের চালক ও সহকারীদের অর্থাৎ শ্রমিকদের সরকার কিংবা মালিক ও শ্রমিক সংগঠন থেকে খাবার, আর্থিক সহায়তা ও কিছু টাকা দেওয়া যেত তাহলে তাদের এ সময়ে বাস চালানোর দরকার পড়ত না। কারণ তাদের জন্য তো এটা চালানো ঝুঁকির। সবমিলিয়ে বলা যায়, এটা ঠিক হয়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘একজন যাত্রী যখন কোথাও যেতে চায়, সে চাইবে আগে যেতে। সে যখন বাসের দরজায় পা রাখবে, তখন সে সেখান থেকে নামতে চাইবে না; এটাই যৌক্তিক। কারণ পরের বাসটি কখন পাবে, সে নিশ্চয়তা তার কাছে নেই। সবমিলিয়ে এটা চিন্তাপ্রসূত কাজ হয়নি বলে আমি মনে করি। কারণ গণপরিবহন চালু রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব নয়।’

এদিকে, দীর্ঘদিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পর গতকাল চালু হওয়ার প্রথম দিন রাজধানীর মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে। তেজগাঁও-নাবিস্কো এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট কোম্পানিতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন ওসমান। তিনি বলেন, ‘বাস চালু করায় স্বস্তি পেয়েছি। প্রতিদিন নাবিস্কো থেকে ইসিবি চত্বরে কখনো হেঁটে কখনো শেয়ারে যেতেই মাসের খরচ শেষ। এখন কিছুটা খরচ সাশ্রয় হবে।’

মিরপুর-১ থেকে মহাখালী হয়ে মতিঝিল চলাচল করা আল মক্কার চালক আবদুল রহিম বলেন, ‘করোনায় সব শেষ। বেকার জীবনের কষ্ট কী তা আমি ও আমার পরিবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। চালক ও হেলপার হয়ে এই পেশায় আসাই যেন আমাদের জন্য পাপ।’ ওই বাসের হেলপার লোকমান বলেন, ‘যখন সামনে যে কাজ পেয়েছি তাই করেছি। বাস ছাড়ায় ঈদের আগে স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে এতেই খুশি।’

রজনীগন্ধা পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘রাস্তায় যাত্রী নাই, আমরা এক সিট ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন করছি।’ স্যানিটাইজার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আছে।’ তবে দেখাতে পারেননি।

শেকড় পরিবহনের এক বাসে অফিসগামী এক যাত্রী বলেন, ‘আমরা নিজেরা যতটুকু সচেতনতা দেখাচ্ছি ততটুকুই। অন্যথায় পরিবহনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার তোড়জোড় দেখিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাড়া বেশি আদায় করা হচ্ছে। এসব আসলে দেখার কেউ নেই।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সংক্রমণ,লকডাউন,ঢাকা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close