কাইয়ুম আহমেদ

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

যানজট : স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যও যেন বহু দূর

*হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায় আগে *অধৈর্য শহরবাসী *পরিকল্পনার অভাব, প্রয়োজন শৃঙ্খলা

দীর্ঘ অপেক্ষা, স্বল্প দূরত্বের গন্তব্য যেন বহু দূর। রাজধানীতে এ চিত্র এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ধৈর্যহারা হয়ে উঠছেন শহরবাসী। যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। এখন অবস্থা এমনই যে, হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায় আগে!

প্রতিদিনের এ দৃশ্য দেখে শহরবাসী এখন ক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ। প্রতিনিয়ত যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে শুধু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে, এমনটাই মনে করেন সাধারণ মানুষ। আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করার দাবিও তাদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনের ওপর আস্থা বাড়ানোর পাশাপাশি, সড়কে শৃঙ্খলা আনা গেলেই কেবল যানজটের সমাধান সম্ভব। তবে ট্রাফিক বিভাগ বলছে, উন্নয়ন কাজ চলায় যানজট অতি দ্রুত নিরসন সম্ভব না হলেও বিকল্প পথে যানবাহন চলাচলের মাধ্যমে জট কিছুটা সহনীয় পর্যায় আনার চেষ্টা চলছে। তবে উন্নয়ন কাজের দোহাই দিয়েই সমস্যা থেকে কর্তৃপক্ষ পাশ কাটিয়ে গেলে চলবে না, গণপরিবহন খাতকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি ফুটপাত দখলমুক্তসহ শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে সড়কে।

বুয়েট পুরকৌশল বিভাগ অধ্যাপক ড. হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, একটা শহরকে সাজানোর জন্য আমি গণপরিবহনের দিকে নজর বেশি দেব নাকি প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের দিকে। এখানে পলিসির ক্ষেত্রে প্রাইভেট কার যেন কিনতে না পারে এবং সড়কে প্রাইভেট কারের পরিমাণ যেন বেশি না হয়, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে যানজট নিরসনে নিজেদের নানা উদ্যোগের কথা জানালেও সহসাই বাহনের জট খুলছে না বলে ইঙ্গিত ট্রাফিক বিভাগের।

ডিএমপি ট্রাফিক অতিরিক্ত কমিশনার মফিজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, প্রাইভেট কারে যারা বেশি চলাচল করেন, সেবার মান বাড়িয়ে তাদের বাস ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এদিকে, যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, গড়ে বছরে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিরাজ-উল-ইসলাম বলেন, যানজটে বসে থাকলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। নানা রকম দুশ্চিন্তা ভর করে। এই মানসিক চাপ সব ধরনের রোগের উৎস। চাপের ফলে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যুদ্ধংদেহী মনোভাব চলে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ দীবা বলেন, যানজটের কারণে মানসিক অশান্তি তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়ে পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কে। ব্যক্তির কর্মদক্ষতা, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। যে চালকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালান, তাদের দুর্ঘটনা ঘটানোর আশঙ্কা বেশি থাকে। আর উচ্চমাত্রার শব্দদূষণের ফলে দীর্ঘস্থায়ী বধিরতা তৈরি হতে পারে।

যানজট তৈরির কারণ : ঢাকায় বড় সড়কের সংখ্যা হাতে গোনা। ট্রাফিক মোড়গুলো শহরের বিষফোঁড়া। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কে অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়কের প্রশস্ততা কমে যাওয়া অন্যতম। তা ছাড়া দুই শতাধিক কোম্পানির অধীনে শহরের বাস সেবা পরিচালিত হওয়ার ফলে যাত্রী ওঠানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতাও যানজটের অন্যতম কারণ।

সমন্বয়হীনতা : বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি সংস্থাগুলো শহরকে বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলার পরিবর্তে শহরকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা অভিযোগ করেন, সরকারি এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কাজে সমন্বয় নেই। এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সব পেশার, সব বয়সি মানুষ যানজটের ফলে ভুক্তভোগী। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যানজট নিরসনে কাজ করছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

যানজট নিরসন একক কোনো সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। যানজট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এআরআইয়ের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, পৃথক বাস লেন তৈরি, ট্রাফিক মোড়গুলোর বিষয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দূরত্ব,গন্তব্য,যানজট,রাজধানী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close