reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

কেমন কাটল দশম জাতীয় সংসদের ৪ বছর

আজ ২৯ জানুয়ারি সোমবার চলতি দশম জাতীয় সংসদের ৪ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন করে বর্মমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর পর ২৯ জানুয়ারি শুরু হয় এই সংসদের পথচলা। কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি আগে ভেঙে না দিলে আগামী বছর ২৯ জানুয়ারি শেষ হবে এই সংসদের মেয়াদ। তবে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে মেয়াদ-অবসানে ভেঙে যাওয়া এই সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। আর চলতি অধিবেশনেই আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবে এই সংসদ। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। ফলে রেকর্ডসংখ্যক সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুযায়ী, আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। একইসঙ্গে সরকার নির্বাহী ক্ষমতা হারাবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে, অর্থাৎ আগামী অক্টোবরের পর যে কোনো দিন ওই তফসিল ঘোষণা করতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তখন সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তাদের করতলে চলে যাবে। এই সময়ে বিচার বিভাগও নোটিশ বা শুনানির সুযোগ না দিয়ে তাদের ব্যাপারে কোনো অন্তর্র্বতী আদেশ বা নির্দেশ জারি করতে পারবে না। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে ইসি মেয়াদের শেষ দিন (২৮ জানুয়ারি) থেকে সর্বোচ্চ আরও ৯০ দিন (এপ্রিল পর্যন্ত) সময় নিতে পারবে। তবে নির্বাচনের আগে দেশে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে রাষ্ট্রপতি মেয়াদোত্তীর্ণ সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন। তখন আইন পাস করে ওই সংসদকে বৈধতা দিতে হবে। যার মেয়াদ প্রতিবারে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ছয় মাসের বেশি এ সংসদ কার্যকর থাকতে পারবে না বলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল (পঞ্চদশ সংশোধনী) পরবর্তী এই সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী

দশম জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুর মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে বর্তমান সংসদ। এতে দেশের প্রথম (১৯৭২ সালের) সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে এই সংশোধনী বাতিল করে দেন উচ্চ আদালত। এই বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ রায়ে বর্তমান সংসদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলে পরে বিচার, নির্বাহী ও আইন বিভাগের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

এরই জেরে প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ ঘোষণা, তার ছুটির আবেদন, বিদেশ গমন, পদত্যাগ, দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন ইস্যু আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ত্রিমুখী অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে। এই বিষয়ক জটিলতা এখনও না মিটলেও বর্তমান সংসদকে সফল, বিশেষত বর্জন সংস্কৃতি অবসানকারী সংসদ দাবি করে আসছে প্রধান সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও শুরু থেকে তাদের তালে তাল মিলিয়ে বিরোধী দল পাওয়া জাতীয় পার্টি (জাপা)।

সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এটিকে অবৈধ উল্লেখ করে বারবার এটি ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের দাবি তুলছে। সংসদে না থেকেও প্রায় প্রতিটি সংসদীয় বৈঠকে আলোচনায় ছিল দলটি। কার্যত নিস্প্রাণ চারটি বছর কাটানো এই সংসদ পঞ্চম বছরে পা রাখার প্রাক্কালে শুরু হওয়া ১৯তম অধিবেশনেও সংসদকে ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ তাদের পরিবারের ১৫৫ পাতার দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়।

সংসদ কাজে ভাটা জাতীয় সংসদের প্রতিটি অধিবেশনে প্রতি মিনিটের গড় ব্যয় ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৩৪ টাকা হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক হিসাবে দেখিয়েছে। প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকট হচ্ছে। এজন্য সংসদীয় কাজে ঘটছে ব্যাঘাত। এই বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদ অধিবেশনের কোরাম সংসদের কোনো উন্নতি হয়নি। সংসদীয় কাজে এমপিদের মনোযোগ কম। তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ৪ বছরে মোট ১৩০টি।

আইন পাস সংসদের আইন শাখা জানায়, এই ৪ বছরে চলমান অধিবেশনসহ ১৯টি অধিবেশন বসেছে। আর কার্য দিবস ছিল ৩৪২টি। ৪টি বাজেট পাস করেছে সংসদ। প্রথম অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৩৬টি, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩টি, তৃতীয় অধিবেশনে ১৪টি, চতুর্থ অধিবেশনে ১০টি, পঞ্চম অধিবেশনে ৩৯টি, ষষ্ঠ অধিবেশনে ২৬টি, সপ্তম অধিবেশনে ৮টি, অষ্টম অধিবেশনে ১২টি, নবম অধিবেশনে ২৭টি, দশম অধিবেশনে ৯টি, একাদশ অধিবেশনে ৩২টি, ১২তম অধিবেশনে ১০টি, ১৩তম অধিবেশনে ৫টি, ১৪তম অধিবেশনে ৩২টি, ১৫তম অধিবেশনে ৫টি, ১৬তম অধিবেশনে ২৪টি, ১৭তম অধিবেশনে ৫, ১৮তম অধিবেশনে ১০ ও চলতি ১৯তম অধিবেশনে রোববার পর্যন্ত ১৫ কার্য দিবস চলছে। এসব আইনের মধ্যে অনেক নতুন, মৌলিক ও সংস্কারমূলক আইনও রয়েছে। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ ১৬টি অধিবেশন শেষ করেছে। আর বর্তমানে শীতকালীন অধিবেশন চলছে।

সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমে ভাটা শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সংসদীয় কাজে ভাটা পড়েছে। দশম জাতীয় সংসদ গঠনের পর থেকেই সংসদ চলছে ঢিমেতালে। তবে সংসদে না থাকলেও আক্রমণের শিকার হচ্ছে বিএনপি। সংসদের কার্যপ্রণালী অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি করে বৈঠকের নির্দেশনা থাকলেও একমাত্র নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি ছাড়া আর কেউ তা পূরণ করতে পারেনি। তবে প্রতি মাসে বৈঠক অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি চার বছরে সর্বোচ্চ ৭৪টি বৈঠক করেছে।

সংসদ প্রাণবন্ত হয়নি সরকার ও বিরোধী দল প্রাণবন্ত রাখার ঘোষণা দিলেও অধিবেশনগুলোতে কোরাম সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দশম সংসদের একাদশতম এ অধিবেশনের প্রায় প্রতিদিনই নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে। বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর আরও সংকটাপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয়েছে সংসদকে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকলেও কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ ছিল। বিরোধী দলহীন সংসদ কার্যকর হয় না।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম

সরকারের ইতিবাচক অর্জনে প্রাণবন্ত আলোচনায় বিরোধী দলের সরব উপস্থিতি ছিল নজরকাড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী-তনয়া সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকীর সাফল্য অর্জন, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের দেয়া ভাষণকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রদান ছিল অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ যুক্ত হওয়ায় সংসদে ধন্যবাদ প্রস্তাবও গৃহীত হয়। এদিকে কূটনৈতিক সফলতা বিশ্বের সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে বলেও ঐক্যবদ্ধভাবেই দাবি করছে সরকার ও বিরোধী দল।

একই বছরে সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোর সর্ববৃহৎ দুটি সংস্থার কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলন আয়োজনকে তারা বর্তমান সংসদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরকারবিরোধী দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর তোলা অভিযোগের জবাব হিসেবে দেখছে। সেইসঙ্গে তারা বলছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ স্বীকৃতি পাওয়া সংসদ নেতার নেতৃত্বে সমগ্র সংসদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানেও প্রশংসা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ।

এছাড়া এ সংসদেই পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বাংলাদেশি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। এছাড়া কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে মেয়াদ শেষ হয়েছে দুইজনেরই। বিদেশে সুনাম অর্জন করলেও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এ সংসদ তেমনভাবে কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশে সিপিএ সম্মেলন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ৬৩তম সাধারণ সম্মেলনও দারুণ দক্ষতা ও সুনিপুণভাবে শেষ করে জাতীয় সংসদ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত সাত দিনব্যাপী এ সম্মেলনের জন্য কঠোর শ্রম দেন জাতীয় সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঢাকায় ১ নভেম্বর সিপিএ সম্মেলন শুরু হয়। সিপিএর ৫২টি দেশের মধ্যে ৪৪টি দেশ, ১৮০টি শাখার মধ্যে ১১৪টি শাখা এবারের সম্মেলনে অংশ নেয়। এসব দেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের ৫৬ স্পিকার, ২৩ ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদ সদস্যসহ ৬১৩ জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশে আসেন। সম্মেলনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্তভাবে দ্রুত মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে একটি বিবৃতি গৃহীত হয়েছে। এছাড়া এ সম্মেলনে পরবর্তী তিন বছরের জন্য সিপিএ নতুন চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

বিরোধী দলের দাবি

৪ বছর পূর্তিতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দাবি তারা সরব ছিল সংসদে। সমাপ্ত বছরে সংসদ উত্তপ্ত হওয়া শুরু হয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এক হঠকারী সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে। বাজেট অধিবেশনে ব্যাংকের আমানতকারীদের ওপরে আবগারি শুল্ক ধার্য করে সরকারি দলের সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। দলের সিনিয়র সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পরবর্তী সময়ে তিনি অবস্থান বদলাতে বাধ্য হন। বিগত বছরগুলোতে হাতেগোনা কয়েকবার সংসদ বর্জন (ওয়াক আউট) করেছিল বিরোধী দল। সর্বশেষ চলতি অধিবেশনে ব্যাংক কোম্পানি আইন পাসের প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন তারা। জাতীয় নির্বাচনের এই বছরের শুরু থেকেই অবশ্য সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিরোধী দল।

জাতীয় সংসদের ৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি সংসদে ও সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা সুস্থ ধারার রাজনীতি ও দেশের স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। জাতীয় পার্টি সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি পাল্টে দিয়েছে। জনগনের স্বার্থে জাতীয় সংসদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলেও দাবি করেন তিনি।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দশম জাতীয় সংসদ,সংসদের ৪ বছর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist