আবদুল্লাহ আল মামুন, মাদারীপুর

  ০৫ মার্চ, ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান

মেজরসহ ৪০ সেনা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে

খলিলুর রহমান খান ১৯৭১ সালে ছিলেন মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের ছাত্র। একাত্তরে ৭ মার্চের আগেই মাদারীপুরে গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১ মার্চ নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে। ৪ মার্চ মৌলভী আচমত আলী খানকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। ১০ মার্চ শহরে শুরু হয় যুদ্ধের মহড়া। ২৬ মার্চ নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় খলিলুর রহমান খান ছিলেন মাদারীপুরে খলিল বাহিনীর কমান্ডার।

মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান জানান, পাকিস্তান বাহিনী মাদারীপুরে ঢুকেই মেতে ওঠেছিল জ্বালাও-পোড়াও, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে। ১৭ এপ্রিল স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে ১৬৫ জন ছাত্র-যুবককে একত্রিত করে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসের শেষের দিকে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল প্রথম মাদারীপুরে প্রবেশ করে। পরে দফায় দফায় আরো মুক্তিযোদ্ধা মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

খলিলুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালে ১৭ মে শিবচর (গুয়াতলা) বরহামগঞ্জ গণহত্যার ঘটনা ঘটে। ওই সময় বেশ কয়েকটি গ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এর মধ্যে গুয়াতলায় ছিল ধনী হিন্দুদের বসবাস। এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীরা হিন্দুদের হত্যা করে তাদের সহায় সম্পদ দখল করার জন্য আগেই নীলনকশা তৈরি করে রেখেছিল। সে সময় মাদারীপুর সদরসহ অন্যান্য স্থান থেকে শিবচরের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। নৌপথ ছাড়া যাতায়াতের কোনো বিকল্প ছিল না। এ সুযোগটাই কাজে লাগায় হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা। ঘটনার দিন স্বাধীনতাবিরোধীরা মাদারীপুর সেনা হেড কোয়ার্টার (এ আর হাওলাদার জুট মিল) থেকে লঞ্চবোঝাই করে সৈন্য নিয়ে যায়। আড়িয়ালখাঁ নদ হয়ে শিবচর উৎরাইল বন্দরের উত্তর-পূর্ব পাড় চরশ্যামাইল (শিবরায়ের কান্দি) ঘাটে নেমেই হানাদার বাহিনী রাজাকারদের ইশারায় চরশ্যামাইল ও তার আশপাশের এলাকায় ধ্বংসলীলা শুরু করে। এদের পরাস্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা মারমুখী হয়ে উঠেন। দীর্ঘ ৯ মাস চলে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ।

মুক্তিযোদ্ধা খলিল জানান, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ে। একে একে এলাকাছাড়া হয়ে হানাদার ও তাদের দোসররা মিলিত হয় জেলা শহরের এ আর হাওলাদার জুট মিলের ক্যাম্পে।

এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মাদারীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক পরাস্ত করতে থাকে পাকিস্তান বাহিনীকে। বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হানাদার বাহিনী ও দোসররা মাদারীপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কৌশল খুঁজতে থাকে। আমরা গোপনে জানতে পারি, হানাদার বাহিনী এ আর হাওলাদার জুট মিলের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে আমার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৮ ডিসেম্বর সারা রাত অবস্থান নেয় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সমাদ্দার ব্রিজের চতুর্দিকে। ব্রিজটি জেড ফোর্সের মুক্তিযোদ্ধারা আগেই মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায় শত্রুবাহিনী গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে পার হচ্ছিল। তখনই আমরা চতুর্মুখী আক্রমণ করি। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। একটানা ৩ দিন ২ রাতের যুদ্ধে গ্রামবাসীও এগিয়ে আসে।’

খলিলুর রহমান খান আরো বলেন, ‘সেই দিনটি আমাদের মাদারীপুরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সেই দিনে হানাদার বাহিনী সমাদ্দার ব্রিজে আমাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হই এবং পাকিস্তানি মেজর আবদুল হামিদ খট্টক এবং আরো জীবিত ৩৯ জন অর্থাৎ মোট ৪০ পাকি সেনা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানকার যুদ্ধে ২০ পাকি সেনা ও ৩০ রাজাকার নিহত হয়। এ যুদ্ধে মাদারীপুরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চু ১০ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে শহীদ হন এবং আক্তারুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বীর মুক্তিযোদ্ধা,খলিলুর রহমান খান,আত্মসমর্পণ,মাদারীপুর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close