বিবিসি

  ২২ নভেম্বর, ২০১৭

শেষবার বিন লাদেনকে যেমন দেখেছিলেন হামিদ মীর

ওয়াশিংটন আর নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তানে যখন আমেরিকান নেতৃত্বে বোমা হামলা চলছে, যখন আমেরিকা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের চোখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেনকে, তখন লাদেনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর।

ওসামা বিন লাদেনের একাধিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হামিদ মীর মনে করেন, ‘আমি মনে করি সাংবাদিক হিসেবে আমি একটা ইতিহাসের সাক্ষী।’ হামিদ মীর জানান, ‘আমি যখন আফগানিস্তানে ঢুকলাম, সেখানে তখন ভয়ংকর অবস্থা। ঘটনাস্থলের দৃশ্য অবর্ণনীয়, চারদিকে ধ্বংসলীলা, মৃতদেহ। নিজেকে আমি বলছিলাম, “তুমি পাগল নাকি, এখানে কেন এসেছো?”’

২০০১ সালে নভেম্বরের গোড়ার দিকে হামিদ মীরের পরিচিত আলকায়েদার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি তাকে সঙ্গে করে কাবুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলকায়েদার একজন লোককে ঠিক করে দেন। হামিদ মীরের ধারণা, তাকে কাবুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাতের অন্ধকারে অ্যাম্বুলেন্সে করে চোখ বেঁধে। তাকে যেখানে নেওয়া হয় সেখানে আমেরিকা তখন প্রচণ্ড বিমান হামলা চালাচ্ছে।

‘সে রাতটা ছিল আমার জন্য খুবই কঠিন। যেসব আলকায়েদা যোদ্ধা সেখানে ছিল, তারা প্রত্যেকেই প্রাণ দিতে চায়। প্রত্যেকেই শহীদ হতে চায়। ভবনটির ওপর মুহুর্মুহু হামলা চালানো হচ্ছে। আমি তখন আমার স্ত্রীকে একটা চিঠি লিখে বলেছিলাম, “আমি দুঃখিত, আমি হয়তো এখানে মারা যাব, বাচ্চাদের দেখো।”’

এর আগে দুবার ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন হামিদ মীর। তিনি বিন লাদেনের কাজের ধারা নিয়ে খোলাখুলিই সমালোচনা করতেন, কিন্তু বিন লাদেন তাকে বলেছিলেন, তার বক্তব্য বাইরের বিশ্বের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারায় মীর তার আস্থা অর্জন করেছেন। তবে ১৯৯৭ সালে হামিদ মীর যখন প্রথম বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন বিন লাদেন সম্পর্কে তিনি বিশেষ কিছুই জানতেন না।

‘তার কাছে আমি পৌঁছেছিলাম, তৎকালীন তালেবান নেতা মোল্লা উমরের মাধ্যমে। বিশ্বাস করুন, সে সময় আমি ওসামা বিন লাদেনের কথা জানতামই না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি কে? উমর আমাকে বলেছিলেন উনিই তো সেই ব্যক্তি যিনি সোমালিয়ায় আমেরিকানদের ওপর হামলা চালিয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদেরও হত্যা করেছেন।’

মোল্লা উমর বলেছিলেন, তিনি লাদেনের সঙ্গে হামিদ মীরের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেবেন। ‘এরপর ওরা আমাকে নিয়ে গেল তোরাবোরা পাহাড়ে।’

‘আমার মনে আছে, সময়টা তখন সন্ধ্যা। যখন আমি পাহাড়ে একটা গুহায় ঢুকলাম, তখন কয়েকজন আরব আমাকে থামাল। আমার সারা শরীরে তল্লাশি শুরু করল, এমনকি আমার জাঙ্গিয়ার মধ্যে হাত ঢুকিয়েও তারা তল্লাশি চালাচ্ছিল। আমি চেঁচামেচি শুরু করলাম। কারণ ওদের আচরণ খুব একটা সভ্য ছিল না। হঠাৎ করে একজন লম্বা লোক এসে হাজির হলেন, জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? ওরা তার সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলছিল। বুঝলাম উনি ওসামা বিন লাদেন।’

মীর বলেন, বিন লাদেন খুব ভদ্র ও নম্র ছিলেন। তিনি তার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, এটা তাদের নিরাপত্তা পরীক্ষার একটা অংশ। বলেছিলেন তার পরিবারের লোকজন দেখা করতে এলেও এভাবেই তাদের পরীক্ষা করা হয়।’ তাদের আবার দেখা হয় ১৯৯৮ সালে। এরপরই আসে ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারের ওপর ঐতিহাসিক ও নাটকীয় হামলা।

ওই হামলার ঘটনার সময় মীর ছিলেন নিজের অফিসে। ‘বিকেলের শেষ দিক তখন। একজন আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। আগে তাকে কখনো দেখিনি। তিনি আমাকে একটা ঘড়ি দিয়ে বললেন ওটা শেখের উপহার। হাতঘড়িটা আমি ওসামা বিন লাদেনকে পরতে দেখেছিলাম যখন দ্বিতীয়বার আমি তার সাক্ষাৎকার নিই। যখনই নামাজের সময় হচ্ছিল ওই ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছিল। ঘড়িটা আমি চিনতে পারলাম। বুঝলাম ওসামা বিন লাদেন উপহারটা পাঠিয়েছেন।’

ওই ব্যক্তিকে হামিদ মীর জিজ্ঞেস করেছিলেন, শেখ তাকে কেন পাঠিয়েছেন? লোকটি তাকে বলেছিল, তিনি মীরকে একটা চিঠি দেবেন। কিন্তু আপাতত তার অফিসে একটু বসার অনুমতি চান। বলেছিল, টিভিতে সিএনএন বা বিবিসি কোনো একটা চ্যানেল একটু ছাড়তে।

‘কিছুক্ষণ পরে ঘরে গিয়ে দেখি লোকটি লাফাচ্ছে, নাচছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো? সে বলল, দেখো টিভিতে দেখো আমেরিকার ওপর হামলা হয়েছে! আমি বললাম, ওটা তো একটা বিমান দুর্ঘটনা। কিন্তু দেখলাম সে খুশিতে চেঁচাচ্ছে। আর বলছে, বাহ! আরেকটা আক্রমণ, দ্বিতীয় আক্রমণ। তার সে কী উল্লাস, আমার মনে হচ্ছিল সে বিরাট বিপজ্জনক একটা মানুষ।’

১১ সেপ্টেম্বরের ওই জোড়া হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় তিন হাজার মানুষ। নজিরবিহীন ওই আক্রমণ বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানার পর আফগানিস্তান থেকে আসা ওই দূত হামিদ মীরের হাতে একটা চিঠি তুলে দেয়। চিঠিটি লিখেছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

সেটা ছিল ছোট্ট একটি বিবৃতি। লেখা ছিল-‘যারা এই অভিযান চালিয়েছে তাদের আমি প্রশংসা করি। কিন্তু আমি এ হামলার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নই।’ হামিদ মীর চিঠিটি প্রকাশ করেন। তোলপাড় পড়ে যায় সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে। অনেক সংবাদ অনুষ্ঠান তার সাক্ষাৎকার নেয়। অনেকে তার ব্যাপক সমালোচনা করে সন্দেহ প্রকাশ করে যে তিনি আলকায়েদার খুবই ঘনিষ্ঠ।

আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বের ওপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণ শুরুর এক মাস পর হামিদ মীর তৃতীয়বার যান বিন লাদেনের কাছে। ‘আমি হাতে লেখা একটা চিঠি পেয়েছিলাম, জালালাবাদ আসতে পারবে? আমি ভেবেছিলাম এটা হয় একটা ফাঁদ- নয়ত কেউ আমার সঙ্গে মশকরা করছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম চিঠিটা হাতে পেয়ে, কারণ ব্যাপারটা ছিল খুবই ঝুঁকির।’

কেমন দেখেছিলেন তিনি বিন লাদেনকে?

হামিদ মীর বলছেন, পুরো আবেগহীন আর শান্ত ছিলেন বিন লাদেন। নর্দান অ্যালায়েন্স আর আমেরিকান বাহিনী তখন কাবুলের দখল নিতে যাচ্ছে। ‘আমার মনে আছে, তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমেরিকানরা আমাকে জীবিত ধরতে পারবে না।’ মীর বলেছেন বিন লাদেনের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে প্রতিবারই তিনি সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করে লাদেনকে তার কাজের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

‘এমনকি প্রথমবার সাক্ষাৎকারের সময়ও আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি সোমালিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের কেন মেরেছিলেন? দ্বিতীয়বার আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ইসলামী আদর্শের দোহাই দিয়ে তিনি কোন যুক্তিতে নিরীহ অমুসলিম মানুষদের হত্যাকে সমর্থন করছেন? তৃতীয়বারেও আমি তাকে বলেছিলাম, আমেরিকায় যারাই থাকে তারা সবাই খারাপ এ কথা তিনি কীভাবে বলেন?’

মীর বলেন তৃতীয়বারের ওই সাক্ষাৎকারে নেওয়ার সময় তারা যখন কথা বলছেন, তখন বিন লাদেনের নিরাপত্তারক্ষীরা সন্দেহ করে যে বাইরে একজন গুপ্তচর রয়েছে এবং হামলা হতে পারে। মুহূর্তে একটা ত্রাস তৈরি হয়।

‘হঠাৎ শুনলাম তারা চিৎকার করছে পালাও পালাও। তখনো বিন লাদেন খুবই শান্ত ছিলেন। তারপরেই তিনি বললেন, ‘ইয়েল্লা, ইয়েল্লা, ইয়েল্লা-যাও, যাও, যাও। ওনার সঙ্গে আমার সেটাই ছিল শেষ কথোপকথন।’

তারা সবাই সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়েছিলেন ৫ মিনিটের মধ্যে। তার ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে সেখানে শুরু হয়েছিল বোমাবর্ষণ। বিন লাদেন আর মীর দুজনেই বেঁচে গিয়েছিলেন। হামিদ মীরকে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি গেলেন একদিকে আর ওসামা বিন লাদেন ও তার দলবল আরেকদিকে। এর কয়েক দিনের মধ্যে বিন লাদেন গোপন আস্তানায় চলে যান। এর ১০ বছর পর পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তার সন্ধান মেলে একটি সেনাঘাঁটির কয়েক শ মিটার দূরত্বে এক গোপন ডেরায়।

ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কারণে হামিদ মীরকে অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অনেকে বলেছে, আলকায়েদার হয়ে তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু হামিদ মীর মনে করেন, তিনি সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘আমি একমাত্র সাংবাদিক নই যে, ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহী ছিল। সে সময় সব সাংবাদিকই তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে, কারণ তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার আদর্শের সঙ্গে আপনি একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকের জন্য তিনি খবরের উৎস। কাজেই আমি মনে করি, সাংবাদিক হিসেবে আমি একটা ইতিহাসের সাক্ষী।’ হামিদ মীরই শেষ সাংবাদিক যিনি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ওসামা বিদ লাদেন,হামিদ মীর,আফগানিস্তান,সাক্ষাৎকার,সাংবাদিক
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist