আবদুল্লাহ আল মেহেদী

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

জয় মানবতার জয়

রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের নেত্রী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি যা-ই বলুন, বাস্তব অবস্থা কিন্তু ভিন্ন। স্থানীয় বৌদ্ধ তরুণরাই সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। এমনই ছবি আসছে বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়ায়। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তলোয়ার আর রামদা হাতে টহল দিচ্ছে সারাক্ষণ বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘মাবাথা’র জাতি ও ধর্ম রক্ষার আন্দোলনের ফলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে গত ২৪ আগস্টের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধদের উদ্যোগে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার ফলে রাখাইন তথা পুরো মিয়ানমারই এখন রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে।

রাখাইন প্রদেশের কোথাও কোথাও বন এবং পাহাড় থাকলেও সেখানে যে বাঘ নেই, এটা নিশ্চিত করেছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তবু উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের অবস্থা যেন ‘জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ।’ ডাঙ্গায় থাকলে বাঘের চেয়ে ভয়ঙ্কর নরঘাতকের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আবার জলে নামলে কুমিরের পেটে না গেলেও রয়েছে ডুবে মরার আতঙ্ক। তাই তারা মন্দের ভালোটা বেছে নিয়ে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকায় অশান্ত নাফ ও উত্তাল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর গণহত্যা চালিয়ে তাদের বিতাড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সোচ্চার হয়ে উঠছে। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সাড়া ধীর। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অসংখ্য রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে বলেও সেখানে মন্তব্য করা হয়েছে। ডেসমন্ড টুটু, মালালা ইউসুফজাই প্রমুখ নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব জোরালো আওয়াজ তুলেছেন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পাশাপাশি দেশে দেশে নাগরিকদের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাতে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-তুরস্কের পর ইউরোপের নগরগুলো যুক্ত হয়েছে। মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাঁড় করাতে আহ্বান জানিয়েছে আরব পার্লামেন্ট।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও ভয়াবহ নির্যাতন আড়াল করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সন্ত্রাসবাদ দমনে সহায়তা চাওয়ার কূটনৈতিক কৌশল নিয়েছে মিয়ানমার। একই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে রাখাইন পরিস্থিতি ঘিরে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে পক্ষে রাখতে পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। এর অংশ হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরো বেশি আকর্ষণ করতে উদারনীতির কথাও জানাচ্ছে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে শুরু থেকেই চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মমতায় অং সান সু চির অব্যাহত নীরবতায়ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিক্ষোভকারীরা। নির্যাতন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও। রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে শুরু থেকেই মিয়ানমারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, পাকিস্তান। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ রাশিয়ার সচেতন মানুষও ধিক্কার জানিয়েছে মিয়ানমারকে। মস্কোর পাশাপাশি চেচনিয়ার জনগোষ্ঠীও গণহত্যা বন্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। এই সভ্যতাবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছে আমাদের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতের নাগরিকরাও। দেশটির রাজধানী দিল্লিসহ পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শহর কলকাতা এবং পাঞ্জাব রাজ্যেও ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতেও তৎপরতা এখনই বন্ধ করার ডাক উঠেছে।

রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে অসহায় রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘ ধারণা করছে, গত ২৫ আগস্টে নতুন করে সেনা সহিংসতা শুরু হওয়ার পর ১৫ দিনে ২ লাখ ৭০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সর্বশেষ সেনা সহিংসতার আগেই বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এত বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার জায়গা দেওয়া ও এর বিশাল ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্বিচার হত্যা বন্ধের পাশাপাশি দেশের এসব শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে এ আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না মিয়ানমার।

ইরাক ও আফগানিস্তানের পর এরই মধ্যে বিশ্বে সর্বোচ্চসংখ্যক শরণার্থীর জোগানদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মিয়ানমার। শুধু রাখাইন রাজ্যই নয়, মিয়ানমারের আরো অনেক রাজ্যেই জাতিগত সমস্যা রয়েছে। তবে অং সান সু চির সরকার রোহিঙ্গা ছাড়া অন্য সবার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি আশ্রয় পেয়েছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ, মালয়েশিয়ায় ৪০ হাজার, ভারতে ৪০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজারেরও মতো রোহিঙ্গা আছে বলে জানা যায়।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, খুব সম্ভবত মিয়ানমার সরকার নিহতের সংখ্যা অনেক কম করে বলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ও ভয়াবহ বিষয় হলো মিয়ানমার সরকার সেখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি জানার সুযোগ হচ্ছে না। মিয়ানমার একদিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দিয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন অভিযানের নামে নির্বিচারে হত্যা করছে বা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করছে, অন্যদিকে নাগরিকত্ব প্রমাণ ছাড়া ফিরিয়ে না নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে এবং ফিরে যাওয়া ঠেকাতে সীমান্তে মাইন পোতা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ করলেও মিয়ানমার তা থামায়নি। বরং এবার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী মাইন পোতা অব্যাহত রেখেছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে সাধারণ বিতর্ক পর্বে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি উঠেছে। সেখানে উদ্বুত ঘটনার জন্য মিয়ানমারকে দায়ী করা হয়।

এদিকে ভারতের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ইন্দোনেশিয়ায় বিশ্ব সংসদীয় ফোরামের বৈঠকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে গৃহীত প্রস্তাব সমর্থন করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। তবে সবকিছুই পাল্টে দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। যে আদালতে বিচার চলছে মিয়ানমার সরকারের নির্বিচার গণহত্যা এবং ভূমিপুত্র রোহিঙ্গাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার সহিংস আচরণের। আগামী শুক্রবার শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হবে। আর এই রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে বিশ্ব জনমত সব সময়ই মানবতার পক্ষে থেকেছে এবং এবারো তার ব্যত্যয় ঘটেনি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাখাইন,অং সান সু চি,বৌদ্ধ,রোহিঙ্গা সংকট,ভারত,মানবতা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist