reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

বিশ্ব দরবারে রাখাইন সংকট

মিয়ানমারে এমন ঘটনা যে এবারই প্রথম হচ্ছে, তা নয়। এর আগেও এমন ঘটনা সেখানে ঘটেছে। প্রতিবারই বিশ্ব জনমত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কিন্তু এবার মিয়ানমারের কৌশল একটু ভিন্ন কি না, তা ভেবে দেখতে হচ্ছে। রাখাইন রাজ্য পুরোপুরি রোহিঙ্গামুক্ত করতে পারলে দেশটিকে আর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে না। গত বছর এমন কথা উচ্চারণ করেছিলেন নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলছিলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে সেখানেও রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া বা কসোভোর মতো গণহত্যা অবধারিত। অনিবার্যভাবে সে পরিস্থিতির দিকেই হাঁটছে মিয়ানমার। সন্ত্রাস দমনের নামে মিয়ানমারে যা হচ্ছে, দৃশ্যত তা গণহত্যা।

জাতিসংঘও স্বীকার করে নিয়েছে সাধারণ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দমনের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের এই জনগোষ্ঠীকে সমূলে উৎপাটন করতে চাইছে। মানবাধিকারের ভাষায় যাকে বলা হয় এথনিক ক্লিনজিং। এমন সঙ্কীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে সাম্প্রদায়িক আস্ফালন পৃথিবীর যে প্রান্তে দেখা যাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্ববাসীকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান। বিশ্ব মুসলিম দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

যারা গণতন্ত্রের লেবাস পরে এই গণহত্যা চালাচ্ছে, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে যেসব মানুষ, তারাও এই গণহত্যার জন্য দায়ী। এরদোয়ান বলেছেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া তুরস্কের নৈতিক দায়িত্ব। ইতোমধ্যে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতার শুরু। এদিনই পুলিশ বা নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থি রোহিঙ্গাদের হামলার জবাবে সেনাবাহিনী তীব্র আক্রমণ শুরু করে। ফল হিসেবে শরণার্থীর ঢল নামতে থাকে বাংলাদেশের দিকে। মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বেসামরিক রোহিঙ্গাদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। মর্টার ও মেশিন গান ব্যবহার করে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মিয়ানমারে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যকার এই সহিংসতায় এই অঞ্চলে হিম অনুভূতি বিরাজ করছে। জাতিসংঘ রাখাইনে গণধর্ষণ, গণহত্যা হচ্ছে বলে প্রামাণ্য তথ্য পেয়েছে। তারা বলেছে, নবজাতক, কিশোর বয়সীদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। নৃশংসভাবে প্রহার করা হচ্ছে। গুম করে দেওয়া হচ্ছে। ওআইসি মহাসচিব বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। রাখাইনে সহিংসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আবারো আহ্বান জানিয়ে মহাসচিব বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বৈধতার প্রশ্নে স্থায়ী সমাধান দরকার।

এদিকে ইইউ বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উত্তেজনা প্রশমন জরুরি। সব পক্ষের উচিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেডেরিকা মঘেরিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতির ওপর ইইউ নজর রাখছে। ইইউর এই হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, রাখাইনে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি সাহায্যকর্মীদের বাধাহীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। মিয়ানমারের সরকার অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই সুপারিশগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের বাস্তবায়ন করা উচিত।

অন্যদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিষয়টিকে আর অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি নিউইউর্কে সাংবাদিকদের বলেন, সম্প্রতি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি রাখাইন রাজ্যে যে হামলা চালিয়েছে, আমি তার নিন্দা জানাই। কিন্তু আমরা ধারাবাহিকভাবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নির্বিচারে হামলা চালানোর অভিযোগ পেয়ে আসছি। রোহিঙ্গাদের ভেতরে ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। বর্তমান পরিস্থিতি এই অঞ্চলে উগ্রবাদকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। জাতিসংঘ মহাসচিব রাখাইনের মুসলিমদের জাতীয়তা বা আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে বলেন, সহিংসতা এড়িয়ে একটি সামগ্রিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।

অন্যদিকে জাতিসংঘের আঞ্চলিক সংস্থাগুলো আগামী তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিতে দেখার জন্য সু চির প্রতি আহ্বান জানান করবিন। ব্রিটেনের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবিসির উর্দু বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে করবিন বলেছেন, আমরা সু চির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার উদ্দেশে আমার বার্তা হলো-আমরা আপনাকে পছন্দ করি। আমরা আপনার সমর্থনে মিছিল করেছি, মানবাধিকারের প্রতি আপনার অঙ্গীকারকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। সু চিকে উদ্দেশ করে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগণের প্রতিও সেই মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরুন। অন্যদিকে ভারত ও চীন এই অঞ্চলের দুই ‘বড় ভাই’। আয়তনে, জনসংখ্যায় তো বটেই, এমনকি শক্তি-সামর্থ্য,ে প্রভাব বিস্তারেও তারা দাপুটে। নিজস্ব বলয় তৈরিতে তারা তৎপর। এই তৎপরতায় দেশ দুটি এত ব্যস্ত এবং এত সতর্ক যে, অনেক ঘটনা তাদের চোখ এড়িয়ে যায়।

রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত ও চীনের কী অবস্থান, সেটা বোঝার জন্য মিয়ানমারের প্রতি এ দুটি দেশের স্বার্থের ধরনটা আগে জানা দরকার। প্রথমে বলা যাক ভারতের কথা। ভারতের দিল্লি, কাশ্মীরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। ভারত সরকার মনে করে, এই রোহিঙ্গারা তার দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই রোহিঙ্গাদের দলে ভেড়াতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার এরই মধ্যে অবৈধ রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কোনো অনুরোধ-আবেদনও তারা গায়ে মাখছে না। জাতিসংঘ বলেছিল, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেওয়া যায় কি না তা ভাবতে। জবাবে ভারতের প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজেজু বলে দিয়েছেন, এ ধরনের প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য। আমরা লক্ষ করছি, ভারত মিয়ানমার বিষয়ে যেকোনো বিবৃতি বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক, বিশেষ করে কোনো পক্ষ যেন সে অবস্থানকে ‘রোহিঙ্গাপন্থী’ বলে ব্যাখ্যা না করে। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় মিয়ানমারের ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হলেও ভারত সরকার সমর্থনের পৈতা ধরেই রেখেছে। এর কারণ ভারত চায় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে। এটা নয়াদিল্লির অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি বাস্তবায়নেরই অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। যদিও তা চীন ও থাইল্যান্ডের তুলনায় কম। ভারত মিয়ানমারকে দুই বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদিও এই নিয়ে মিয়ানমারের বিশেষ সন্তুষ্টি নেই। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বেশ ধীর। এ অবস্থায় সবার চোখ এখন নরেন্দ্র মোদির দিকে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এক বক্তৃতায় বলেছেন, আপনারা আজই দেখুন, পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ মিয়ানমারে হাজার হাজার মুসলমান নিহত হচ্ছে এবং তাদের হত্যা করা হচ্ছে অজ্ঞতা ও বিদ্বেষের কারণে। এ ঘটনায় কোনো কোনো শক্তির রাজনৈতিক হাত থাকার কথা না উল্লেখ করেও যদি ধরে নিই যে, যেমনটি দাবি করা হচ্ছে, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণেই এই গণহত্যা ঘটছে, তা সত্ত্বেও মানবাধিকারের ভুয়া সমর্থকরা মুখ খুলছেন না। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, নৈতিকতা ও মানবাধিকার সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দাবিগুলো মিথ্যা; আর এর উজ্জ্বল প্রমাণ হলো, মিয়ানমারে হাজার হাজার মুসলমান হত্যার বিষয়ে পশ্চিমা সমাজের নীরবতা। সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদ, নানা সংগঠন এবং তারকারা রাখাইন সঙ্কটের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক, ইন্দোনেশিয়ায় রাষ্ট্রপতি জোকোভি, চেচনিয়ার রমজান কাদিরভ এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো কিছু রাজনীতিবিদ রোহিঙ্গাদের কষ্টের চেয়ে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের এজেন্ডা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। আর এভাবেই, এই নেতারা রাখাইনদের মধ্যেকার সংঘর্ষ নিয়ে নিজেদের মতো করে অপ্রচলিত ও তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা প্রচার করছেন। কিন্তু সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে যারা আসলেই আগ্রহী, তারা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের জটিলতা বিবেচনা করে এবং দ্রুত বিচার এড়ানোর কথাই বলবেন।

লেখক : রাজনীতি-বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মিয়ানমার,রাখাইন সংকট,রোহিঙ্গা সংকট,রাখাইন রাজ্য,আন্তর্জাতিক চাপ
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist