সাহাদাৎ রানা

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২০

কর্মমুখী শিক্ষায় বেকারত্ব কমানো সম্ভব

রাষ্ট্র বা দেশ গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কখনো ছিলও না। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এর যথার্থ সত্যতাও মেলে। একটি শিক্ষিত জাতিই পারে সেই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে। আরো সহজ কথায় বলা যায়, উন্নত রাষ্ট্র মানেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত। কারণ পৃথিবীতে যে জাতি সুশিক্ষায় যত বেশি শিক্ষিত; সে জাতি তত উন্নত। উন্নত রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দিলেই তা স্পষ্ট। আর যেসব রাষ্ট্র এখনো উন্নত হয় হয়নি, তারাও প্রতিনিয়ত এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও।

যেকোনো রাষ্ট্রের প্রধান কর্মক্ষম অংশ হলো সে দেশের যুবসমাজ। অর্থাৎ যুবশক্তি। এই যুবশক্তিকে অসাড়, অবশ রেখে রাষ্ট্রের উন্নয়নের কথা কখনো কল্পনাও করা যায় না। এখন বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবকের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের তথ্য। বিপরীতে অস্বস্তির তথ্যও রয়েছে অসংখ্য। কারণ বাংলাদেশে দিন দিন বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ধীরে ধীরে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এখনই রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি পদের বিপরীতে অসংখ্য প্রার্থীর আবেদন তাই প্রমাণ করে। তবে বাস্তবতা হলো, বেকারত্বের কারণে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড সব সময় বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এটা বাস্তব সত্য। কেননা, আমাদের জন্য এখন অন্যতম ভাবনার খবর হলো বেকারত্ব। ধীরে ধীরে বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর আমাদের দেশে বেকারত্বের পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। এর অন্যতম হলো, আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার অভাব। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন কর্মমুখী শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে, তখন আমরা এদিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছি। কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে চাহিদানুযায়ী দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না কার্যক্ষেত্রে। অথচ দেশের সর্বোচ্চ সার্টিফিকেট নিয়েও অসংখ্য শিক্ষিত যুবক ঘুরছে চাকরির বাজারে। মেধার সর্বোচ্চ সার্টিফিকেট থাকার পরও শুধু কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে তাদের থাকতে হচ্ছে বেকার। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্যকে প্রমাণ করে। এর বিপরীতে রয়েছে নতুন পদ সৃষ্টি করতে না পারার ব্যর্থতাও। ফলে দেশের শিক্ষিত বেকাররা ব্যর্থতা ও হতাশায় আক্রান্ত হয়ে বিপথে যাচ্ছেন। এর ফলে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও।

এখন সবার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা কী? জবাবের শুরুতেই বলতে হয়, এটা এমন এক ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই কর্মদক্ষ হিসেবে সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী করে তুলতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি তার মধ্যে লুকায়িত সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে পারে এবং শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একজন শিক্ষার্থী কোন দিকে গেলে ভবিষ্যতে ভালো করবে; সেটাও বোঝা যায় কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের দেশে তাত্ত্বিক জ্ঞাননির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান। এখন তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি যদি ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় করা সম্ভব হয়, তবে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হবে; তেমনি বিদেশেও চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হবে। কারণ, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থী প্রাত্যহিক জীবনে ছোটখাটো কাজ সম্পাদনে নিজেই সচেষ্ট হতে শিখবে। এর ফলে তাকে বেকার হয়ে জীবনের করুণ সময় অতিবাহিত করতে হবে না। কোন না কোন কাজ করে অত্যন্ত জীবনধারণ করতে পারবে সে।


বাংলাদেশে দিন দিন বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এখনই রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি পদের বিপরীতে অসংখ্য প্রার্থীর আবেদন তাই প্রমাণ করে


যেকোনো দেশের প্রধান সম্পদ হলো সে দেশের দক্ষ জনশক্তি। এই দক্ষ জনশক্তিকে যদি সঠিক পরিকল্পনার আওতায় এনে অগ্রসর হওয়া যায়, তবে দেশের জন্য সম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত করা সম্ভব। আমাদের দেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে শুরুর দিকে রয়েছে। কিন্তু কাজের বাজারে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য মানুষ বিদেশে আছেন কাজের জন্য, এটাই সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তবে যথাযথ উদ্যোগ নিলে এখনো জনসংখ্যাকে জনসম্পদ রূপে গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কর্মবিমুখ। অথচ একটি জাতির টিকে থাকা ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন অনেক সুশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী করতে পারলে সেখানে আরো বেশি করে বিভিন্ন পেশার লোকজনের আবির্ভাব ঘটবে। তবে এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন।

আমাদের বাস্তবতা হলো, পারিপার্শ্বিকতার কারণে অনেক আগে থেকেই চাকরির বাজারে তেমন চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও কলা ও মানবিক, সমাজবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষার প্রতি ঝুঁকেন দেশের শিক্ষার্থীরা। বিপরীতে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বিজ্ঞান, সাধারণ শিক্ষা, ব্যবসায় প্রশাসন, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কারিগরি এবং লোকপ্রশাসন বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। তবে এখন এমন চিন্তার কিছুটা পরিবর্তন হলেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদের আসন সংখ্যা কম হওয়ায় অনেকে আগ্রহ থাকার পরও ভর্তি হতে পারছেন না কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে। এর ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। আমাদের দেশে যুবকদের উন্নয়নে, যুব উন্নয়ন অধিদফতর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও তার সুফল সেই অর্থে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও যুব উন্নয়ন অধিদফতর বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর যুবকরা যায়। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানে পাঠ্যসূচিতে বিশেষ করে অষ্টম শ্রেণি থেকে কর্মমুখী শিক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়, তবে তা হবে এককথায় দারুণ।

শুধু তাই নয়, সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার নিশ্চয়তার পাশাপাশি এখন কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন, তা নিয়ে ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মসংস্থানের চাহিদা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। কারণ দিন দিন কী পরিমাণ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিপরীতে কী পরিমাণ কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হতে পারছে; সে বিষয়ে গবেষণা করে একটি নীতিমালা তৈরিও জরুরি। এ ক্ষেত্রে সবার আগে শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। কর্মসংস্থানের দিক বিবেচনা করে পেশাগতভাবে দক্ষ করতে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা দরকার। কেননা, আমাদের দেশের ডিগ্রিগুলো বিষয়ভিত্তিক না হওয়ায় নিয়োগদাতাদেরও দক্ষ কর্মী বাছাই করতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, পদ থাকার পরও দক্ষ জনবল না পাওয়ায় সেসব পদ শূন্য থাকে। এই অসামঞ্জস্যতা দূর করতে পারে শুধু কর্মমুখী শিক্ষাসূচি-সংক্রান্ত সিলেবাস প্রণয়নের মধ্য দিয়ে।

আমাদের সামনে এখন একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ একদিক দিয়ে নয়। নানাদিক দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষ করে শ্রমবাজারে চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি। আর এই চ্যালেঞ্জে জিততে হলে কর্মসংস্থানের চাহিদা ও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় দরকার। তবে হয়তো কারিগরি ও বিশেষায়িত যোগ্যতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী বেরিয়ে আসবে। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে এটা প্রমাণিত হয়েছে, কর্মমুখী ও ব্যবহারিক শিক্ষার শক্তিই হচ্ছে উন্নয়ন ও জাতি গঠনের আসল প্রেরণা; যা জাতীয় জীবনে অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সহজ কথায় হাতে-কলমে শিক্ষাই হচ্ছে এখন একটা জাতির উন্নতির প্রধান চাবিকাঠি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দক্ষতা উন্নয়নে আজকের বিনিয়োগ আগামী দিনের সম্পদ। দক্ষতা না থাকলে কখনো ভালো কিছু করা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশাও অসম্ভব। সবচেয়ে আনন্দের জায়গা হলো কর্মমূখী শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণ হলে প্রথমত দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এর ফলে দেশের বেকারত্ব সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে। কর্মমুখী শিক্ষার আরো একটি বড় গুণ হলো, এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ন জাগ্রত থাকে; যাতে জীবনে হতাশা, শূন্যতা ও ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়। নিজে একা নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কিছু করার মানসিকতা তৈরি হয়। এটাই কর্মমুখী শিক্ষার সবচেয়ে বড় গুণ। তাই একে কাজে লাগিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কর্মমুখী শিক্ষা,বেকারত্ব,কলাম,কর্মসংস্থান
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close