অলোক আচার্য

  ০৩ জানুয়ারি, ২০২০

মুজিববর্ষ এবং এগিয়ে চলার প্রত্যয়

সময়ের বহমান স্রোতে আমরা নতুন বছরে। এটাই নিয়ম। একেকটি বছর শেষ হবে আর নতুন বছর আসবে। থেকে যাবে কিছু হিসাব-নিকাশ। ভুল এবং ভুল শোধরানোর জন্য থেকে যাবে এসব হিসাব। নতুন বছর মানে সবকিছুকে নতুন করে বরণ করে নেওয়া। অতীতের ভুলক্রটিগুলো শুধরে নতুন করে শুরু করা। প্রতিটি বছরে আমাদের দেশ অর্জন করছে নতুন নতুন সাফল্য। সাফল্যের খাতা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। এ যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। আমরা মাথা নোয়াইনি কোনো অন্যায়ের কাছে। বাংলাদেশ কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ায় না। যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, আমরা এগিয়ে যাবই। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমাদের এক দিন চূড়ান্ত অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবে।

২০২০ সাল আমাদের জন্য অন্য বছর থেকে আলাদা। কারণ এই বছরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আমাদের বাঙালি জাতির জন্য এই দুই বছর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সারা দেশে মুজিববর্ষ পালিত হবে। ফেলে আসা বছরে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছি। আবার পাশাপাশি রয়েছে অনেক দুঃখজনক স্মৃতি। যার অধিকাংশই সামাজিক অবক্ষয়জনিত। যেসব স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাই। সেসব ঘটনা যেন আর কোনো দিন আমাদের মঙ্গলকে স্পর্শ করতে না পারে; সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এ দেশ কোনো সন্ত্রাসীর হাতে থাকবে না। আমাদের কোনো সন্তান সন্ত্রাসী হবে না। তারা মানুষ হবে। আমাদের এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কেবল দেশ গড়ার কারিগর হয়েই বের হয়। দেশকে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করতে পারে, সে প্রচেষ্টাই করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হবে এক একজন সম্পদ। কারণ বৃহৎ জনসংখ্যার এই দেশে মানুষই হলো বড় সম্পদ। প্রত্যেকটি মানুষকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই এ দেশ এগিয়ে যাবে দুরন্তগতিতে।

দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। আমরা এখন অর্থনীতিতে সুদৃঢ় অবস্থানে রয়েছি। আমাদের এখন উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটা আমাদের জন্য সত্যিই আনন্দের বিষয়। ক্রমোন্নতির এধারায় বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হবে। একসময় তলাবিহীন এই ঝুড়ির তলা আজ মজবুত। দেশের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে আমাদের গড় আয়ু। প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ উন্নতির সবকটি ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। তবে এই এগিয়ে চলা কেবল আর্থিক মাপকাঠিতে হলেই হবে না। আমাদের পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা আজ ভাবতে বাধ্য করছে যে, আজ আমরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি কি না। উন্নত দেশের বাসিন্দাদের মনমানসিকতাও উন্নত হতে হবে। সামাজিক ঘটনাগুলো আমাদের এই সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। সমাজে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে সামাজিক আস্থাহীনতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ধর্ষণ, খুন, হিংসা, লোভ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, মাদকাসক্তের সংখ্যা, অবসন্নে ভোগা মানুষের সংখ্যা। মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের দূরত্ব। আর এই দূরত্বের ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা। বিশ্বাস শব্দটিই আজ মানুষের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা আজ একজন আরেকজনকে চূড়ান্ত অবিশ্বাস করি। এমনকি এই অবস্থা পরিবারের ভেতরেও। অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের মুক্তিও আবশ্যক। আমরা শ্রেণিহীন সমাজ চাই, আমরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রত্যাশা করি।

আমরা আশা করি, এ দেশ সন্ত্রাসীদের নয়, এ দেশ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। এ দেশ সবার। এ দেশের মানুষ ক্রিকেটের মোস্তাফিজ, মাশরাফি, সৌম্যদের নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসে। পতাকা তুলে সারা মাঠ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। বিশ্বকে জানিয়ে দিতে ভালোবাসি আমরা দেশটাকে ভালোবাসি। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের পর এখন আমরা এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের পথে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এক দিন আমরা সেই অর্জন অবশ্যই করব। আমরা সে শর্তগুলো পূরণ করছি। শিগগিরই আমরা শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশের প্রত্যাশা করতে পারি। আমাদের দেশে চাকরির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে। দেশের চলমান বেকার সমস্যার সমাধান হবে তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরেই। ইতোমধ্যেই দেশে বহু ফ্রিল্যান্সার তৈরি হয়েছে; যারা ঘরে বসেই তাদের চাকরির কাজটি কর চলেছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আজ এক মডেলের নাম। অবকাঠামোগত উন্নয়নেও আমরা এগিয়ে চলেছি। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কয়েক কিলোমিটার আজ দৃশ্যমান। সড়ক যোগাযোগ, রেল যোগাযোগে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে চলেছি। কিছু কিছু ঘটনা সাময়িক সমালোচনার জন্ম দিলেও তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলে সে ঘটনা সেখানেই থেমে যাচ্ছে। অনেক চাওয়া পাওয়ার নতুন নতুন হিসাব নিয়ে নতুন একটি বছর শুরু হচ্ছে। এটিই স্বাভাবিক নিয়ম। আমরা এগিয়ে যাবই দুর্বার গতিতে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, বিদুৎ উৎপাদন বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের শোষণ-নির্যাতন করা পাকিস্তান পর্যন্ত আমাদের সফলতাকে আজ উদাহরণ টানে। এটাই বাংলাদেশ আর আমরা সেই এগিয়ে যাওয়া দেশটার মানুষ। আমরা গর্বিত। আমরা বাংলাদেশের মানুষ সারা পৃথিবিীকে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা সবাইকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, তা কোনো পুরস্কার দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। বরং বাঙালি জাতির অন্তরে তিনি যে আসন করে নিয়েছেন, তাই সর্বোচ্চ। কোনো পুরস্কারের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষের অন্তরে তার অবস্থান। মুজিববর্ষে নতুন প্রজন্ম তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ গঠনে এগিয়ে আসুক।

বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সব ধর্মের মানুষ এখানে একে অন্যের পাশাপাশি চলতে পছন্দ করে। এভাবেই এ দেশ এগিয়ে চলবে দুর্বারগতিতে। কোনো অপশক্তি তা রুখতে পারবে না। আগেও দেশের শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সফল হয়নি। এ দেশের মানুষ তা হতে দেবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই, আমরা সবাইকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চাই। এখানে অশান্তি, বিভেদ ও অসৌজন্যতার কোনো ঠাঁই নেই। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছে। পরাজয়ের মানসিকতা এ দেশের মানুষের মনে ঠাঁই হয় না। এ দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দিয়ে গড়া। এ দেশের উন্নয়নের গতি রোধ করার মতো কোনো শক্তি নেই।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রত্যয়,মুজিববর্ষ,এগিয়ে চলা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close