বদরুল আলম মজুমদার

  ২৩ জুলাই, ২০২০

অনলাইনে বাড়ছে পশু বেচাকেনা

খামারিদের ৩০ শতাংশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে

করোনা মহামারির কারণে এবার পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সরকারিভাবে অনলাইন মাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে অনলাইনের মাধ্যমে গরু কেনাবেচায় উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রমের উদ্বোধনের দিন সরকারের তিনজন মন্ত্রী দেশের একটি জনপ্রিয় অনলাইন থেকে গরু কিনেছেন। তারপর থেকে সাধারণ মানুষও হাটে না গিয়ে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতে পশু দেখছেন। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরা পশু থেকেও এরই মধ্যে অনেকে গরু-ছাগল কিনে ফেলেছেন। আবার অনেকে রয়েছেন কেনার অপেক্ষায়।

অন লাইনে গরু কেনাবেচা নতুন না হলেও এবার করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাধ্যমটি। ক্রেতা এবং খামারি উভয়ই বেচাকেনার জন্য অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করছেন। দেশের বড় বড় খামারিরা আরো মাস খানেক আগ থেকে এ মাধ্যমে গরু বিক্রি শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তাদের স্টকে থাকা গরুর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানায় বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন। সামনের কয়েক দিনে আরো বিক্রি বাড়তে পারে তাদের। তবে এ মাধ্যমে গরু কেনার অসুবিধার কথাও জানা গেছে।

রাজধানীর মিরপুরের মহিবুল নামের একজন ক্রেতা এ মাধ্যমে গরু কেনার কিছু অসুবিধার কথা বলেছেন। তাছাড়া লাইভ ওয়েট পদ্ধতিতে কেনাবেচায় একেক খামারি কেজিতে ভিন্ন ভিন্ন দাম উল্লেখ করছেন। এতে ক্রেতারা পড়ছেন বিভ্রান্ততিতে। একটি ‘সাইটে’ দেশি গরুর লাইভ ওয়েট ৪৫০ টাকা কেজি দেখে মিরপুরের মুহিবুল আশুলিয়ার একজন খামার মালিক থেকে গরু কিনেন। গরুটির দাম নির্ধারণ করে বিকাশের মাধ্যমে ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করেন। পরের সপ্তাহে গরু আনতে গিয়ে দেখেন তিনি দামে ঠকেছেন। এখন তিনি আফসোস করছেন। আবার অনেক গরু কিনে রাখলেও কেনার পরের দিনগুলোতে পরিমাণমতো না খাওয়ানোর অভিযোগ আছে খামারিদের বিরুদ্ধে। যদিও অনেক ক্রেতা কেনার সঙ্গে সঙ্গে পশু জবাইয়ের আগের অবশিষ্ট দিনগুলোর খাদ্যের দাম হিসাব করে দিয়ে দিচ্ছেন।

স্বাভাবিক সময়ের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সচেতন বেশির ভাগ মানুষই মনে করছে হাটে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে করোনার সংক্রমণ এড়ানো যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে রাজধানীর পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় প্রশাসনের উদ্যোগে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে অনেক জেলা প্রশাসন নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছে ওয়েবসাইট ও অ্যাপ। অনেক জায়গায় ওয়েবসাইট তৈরি সম্ভব না হওয়ায় জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেজ খোলা হয়েছে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। আছে ব্যক্তিগত উদ্যোগও। প্রশাসন ও খামারিদের প্রত্যাশা, ঈদের আগে প্রতিদিনই এসব ওয়েব পোর্টাল, অ্যাপ ও ফেসবুক শপের পরিচিতি বাড়বে এবং বিক্রিও হবে।

দেশে বেশ কিছু জেলায় গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের অনলাইন কোরবানির পশুর হাট। কোথাও কোথাও এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে আরো আগে। এজন্য ওয়েবসাইট ও অ্যাপগুলো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর এগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে বিষয়ে খামারি ও ব্যবহারকারীদের প্রায়োগিক কলাকৌশল দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে গত শনিবার নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ কয়েকটি জেলায় কোরবানির পশুর হাটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে জেলা প্রশাসন। নরসিংদীতে জুম কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘অনলাইন বিকিকিনি : নরসিংদীর কোরবানির হাট’ নামক ওয়েবসাইট এবং ‘অনলাইন নরসিংদীর কোরবানির হাট’ নামক মোবাইল অ্যাপের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত জুম কনফারেন্স সভায় সভাপতিত্ব করেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন।

সভায় জানানো হয়, গত বছর নরসিংদী জেলাজুড়ে ৬২টি কোরবানির অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হলেও এ বছর ছয় উপজেলায় তা কমিয়ে ২১টি হাট বসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব কোরবানির হাটে পশু বিক্রির পাশাপাশি ক্রেতারা ঘরে বসে অনলাইনে এই ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে পশু কিনতে পারবেন। মূলত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাটে ক্রেতাদের ভিড় জমানো নিরুৎসাহিত করতেই এই ডিজিটাল হাটের আয়োজন। ওই সাইট ও অ্যাপসে খামারির নাম, পশুর ছবি, আকার, রঙ, ওজন, উচ্চতা, দাঁত, জাত, দাম, বয়স এবং মুঠোফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। এছাড়া এসব অনলাইন প্ল্যাটফরমে থাকছে উপজেলাভিত্তিক কসাইদের নামের তালিকা। ঈদের তিনদিন আগে ওই কসাইদের করোনা পরীক্ষা করানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ক্রেতাদের সুবিধার্থে এমন ২৬টি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এসব ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপসে।

এদিকে পশু জবাই করে মাংস করে হোম ডেলিভারিতে পাওয়ার সুযোগ থাকায় কেউ কেউ আগ্রহী সেই সেবা নিয়েও। মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগে অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে মিলে কোরবানি দিতাম। সবাই মিলে মাংস কাটতাম। এবার অনেকেই ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। তাই এবার নিজেরা একা একা আর মাংস কাটার ঝক্কিতে যেতে চাচ্ছি না। অনলাইনে অর্ডার করলে মাংস কেটে বাড়িতে দিয়ে যাবে। আর পুরো কোরবানি নাকি ভিডিওতে লাইভ দেখা যাবে। তাই সেটাই করব।

ক্রেতা-বিক্রেতার এমন আগ্রহে দারুণ সাড়া পাচ্ছে অনলাইনে পশু বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলো। কোরবানির পশু অনলাইনে বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ‘বিক্রয় ডট কম’র প্রধান বিক্রয় ও বিপণন কর্মকর্তা ঈশিতা শারমিন বলেন, প্রতি বছরই আমরা গ্রাহকদের কাছ থেকে সাড়া পাই। এবার করোনা পরিস্থিতিতে আরো বেশি সাড়া পাওয়ার আশা করছি। অন্যবারের তুলনায় এবার আমরা বাড়তি কিছু সেবা এনেছি যেমন মাংস কেটে বাড়িতে হোম ডেলিভারিতে পাওয়া, শুধু পশু বাড়িতে হোম ডেলিভারি, পশুর ওজন লাইভ দেখার সুযোগ থাকা ইত্যাদি।

তিনি আরো বলেন, এবারের মৌসুমে গত জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে খামারিরা তাদের পশু বিক্রয় ডট কমে নিবন্ধন করা শুরু করেন। এখন পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি পশুর বিজ্ঞাপন সাইটে আছে। তবে শেষ ১০ দিনে এই বিজ্ঞাপনের হার আরো বাড়বে। বিভিন্ন খামারিরা জানিয়েছেন এরই মধ্যে শতাধিক পশু বিক্রির বুকিং তারা পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে গরু ও ছাগল দুটোই আছে।

কোরবানির পশু বিক্রির আরেকটি প্ল্যাটফরম ‘ই-বাজার’। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ব্যক্তি মালিকানায় থাকা বিভিন্ন পণ্য বিক্রির প্ল্যাটফরম হিসেবে সম্প্রতি আমরা ই-বাজারের যাত্রা শুরু করেছি। তবে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে পশু বিক্রিতে এবং কিনতে এরই মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে ই-বাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের বেশিবার ডাউনলোড হচ্ছে ই-বাজার অ্যাপ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার গ্রাহক এতে নিবন্ধন করেছেন।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হাত ধরে প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া পশুর অনলাইন ‘হাট ডিজিটাল হাট ডট নেট’ থেকেও উল্লেখযোগ্য হারে পশু বিক্রি হচ্ছে। প্ল্যাটফরমটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪৪টি বিক্রয় পার্টনার এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৬৭টি পশুর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৯৩টি পশু এরই মধ্যে বিক্রি সম্পন্ন হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
পশু বেচাকেনা,অনলাইন,গরু খামারি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close