নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৩ জানুয়ারি, ২০২০

মিয়ানমার থেকে আনতেই লোপাট ৩০০ কোটি টাকা!

অস্থিরতার দিক থেকে পেঁয়াজ ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছে। গেল সেপ্টেম্বরে ভারত রফতানি বন্ধের পর থেকে বাংলাদেশে পণ্যটি নিয়ে যা হয়েছে তা সাধারণ মানুষ মনে রাখবে অনেক দিন।

এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর দিয়েছে বিস্ফোরক তথ্য। তাদের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, শুধু মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেই বিদেশে পাচার করা হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। আর বলাই বাহুল্য, কাজটা আমদানিকারকদের। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এই অর্থ পাচারের বিষয়টি তদন্ত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে বলেও তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসন্ন রমজানের আগেই চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা জানান।তোফায়েল আহমেদ বলেন, সিটি গ্রুপ আমদানি করবে ৫০ হাজার টন, মেঘনা গ্রুপ ৫০ হাজার, এস আলম গ্রুপ ৫০ হাজার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টিসিবির মাধ্যমে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি উপস্থিত ছিলেন। এনবিআর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্য মতে, মিয়ানমার থেকে ২০১৯ সালে প্রথম পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ৩১ আগস্ট। তখন মিয়ানমারের বাজারে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম ছিল ২৯ টাকা। ঠিক সেই সময়ে দেশের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণাপত্রে প্রতি কেজি ৪৩ টাকা উল্লেখ করেন। অপরদিকে সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৮০ টাকা। তখন ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৩ টাকা দরে আমদানির ঘোষণা দেন। অর্থাৎ প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানিতে ৩৭ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছে।

অক্টোবরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৮২ টাকা। এ সময় আমদানিকারকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণাপত্রে ৪৩ টাকা দর উল্লেখ করে। অর্থাৎ প্রতি কেজি পেঁয়াজে আমদানিকারকরা ৩৯ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করেছেন। পরে নভেম্বরে মিয়ানমারের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ১৩০ টাকা। আর এই সময়ে আমদানিকারকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৩ টাকা দর দেখিয়ে আমদানির ঘোষণা দেন। যেখানে কেজি প্রতি পেঁয়াজে ৯১ টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছে। পেঁয়াজ আমদানিকারকরা যে ঘোষণা দিয়েছেন মূলত তার থেকে অনেক বেশি দরে তারা পেঁয়াজ কিনেছেন। অর্থাৎ আমদানিকারকরা মানিলন্ডারিং করেছেন। আর এভাবেই দেশ থেকে সুকৌশলে পাচার করা হয়েছে ২৯৪ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন পেঁয়াজ কেনার কেত্রে প্রায় ৭০০ ডলার আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। আর এই আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের টাকা আমদানিকারকরা ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভূত হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং করে অন্যভাবে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানির আড়ালে এই পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে। সাধারণত আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে কিন্তু সুকৌশলে আন্ডার ইনভয়েসিং করে এই অর্থ হুন্ডিতে পাচার করা হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড কাস্টমসের তথ্য মতে, চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৩৪ হাজার ৮৬১ দশমিক ৩৮ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে এই পেঁয়াজ আমদানি মাধ্যমে মিয়ানমারে পাচার হয়েছে ২৯৪ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪০ টাকা। আমদানিকারকরা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (চালানপত্রে পণ্যের দাম কম দেখানো) এই টাকা পাচার করেছেন।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, মানিলন্ডারিংয়ের আলামত আমরা পেয়েছি। এ বিষয়ে এনবিআরকে অবহিত করা হয়েছে। এনবিআরের অনুমতি পেলে অনুসন্ধান করে আরো বিশদ তথ্য পাব বলে আশা করছি।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এর জন্য দায়ী ব্যাংক। আর পণ্য আনার পরে কাস্টমসের কিছু করার থাকে না। ধরা পড়ার পর সেটা নিয়ে আলোচনা হলেই তখন কাস্টমসের ওপর দোষ আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু দায়িত্ব আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এগুলো মনিটরিং না করে তাহলে এভাবেই অর্থ পাচার হতে থাকবে। আর অর্থনীতিতে পিছিয়ে যাবে দেশ। তাই এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার এমন একটি প্রতিবেদন আমি পেয়েছি। অর্থ পাচারের বিষয়টি আমরা অনুসন্ধান করব। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেন তারা দেশের শত্রু। আমরা এই অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনব। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগলেও অপরাধীরা সাজা পাবেনই।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মিয়ানমার,পেঁয়াজ,শুল্ক গোয়েন্দা,এনবিআর
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close