সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শাহ্জাহান সাজু
ব্যাংক-বীমা বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে : মো. গোলাম ফারুক
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটি ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে যাত্রা শুরু করে। আর্থিক খাতের নানা সংকটের মধ্যেও ব্যাংকটি তার সাফল্য জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এসবিএসি ব্যাংক সর্বাধিক পরিমাণের মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই সফলতার পেছনে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোঃ গোলাম ফারুকের মেধাবী নেতৃত্বের অবদান সর্বজনবিদিত। তিনি মনে করেন, দেশের যত বড় বড় গ্রুপ আজ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, এর সবই কোনো না কোনো ব্যাংকের সৃষ্ট। ব্যাংক-বীমা বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। কৃষিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার পেছনেও রয়েছে ব্যাংকের অবদান। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
প্রতিদিনের সংবাদ : সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় দুর্বল হয়ে পড়ায় একাধিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
গোলাম ফারুক : সরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার ফাঁকফোকর গলে নানা ধরনে অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব, দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং পেশাদারিত্বের অভাবেই সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ধাপে ধাপে দুর্বল ব্যাংকে পরিণত হয়। যথাযথভাবে ঋণগ্রহীতা নির্বাচনে কোনো মুনশিয়ানার পরিচয় না মেলায় এবং ঝুঁকি বিশ্লেষণে অর্বাচীনতা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। গুটিকয়েক লোকের হাতে ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া এবং যথাযথভাবে প্রকল্প মূল্যায়নে ব্যাংকের অদক্ষতা, শ্রেণিকৃত, ঋণ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ঋণ ঝুঁকি সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে হ্রাস করা যেত। এক্ষেত্রেও ব্যাংকাররা গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমি মনে করি বর্তমানে রেগুলেটরি বডির ক্লোজ সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে কারণে ব্যাংকিং খাতের এ জাতীয় দুর্বলতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বৃহৎ ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা হ্রাস, একই লোকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদানে সিন্ডিকেশন করা, ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক গুরুত্ব দেওয়াসহ অর্থঋণ আদালত আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন হলে সহসাই এ খাত ঘুরে দাঁড়াবে এবং দাঁড়াচ্ছেও।
প্রতিদিনের সংবাদ : বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে যাচ্ছে। এর পেছনে ব্যাংকিং খাতের অবদান কতটা বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম ফারুক : বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের যে অবস্থা সাধারণত হয়ে থাকে তার চেয়েও কল্পনাতীত খারাপ অবস্থা বিরাজমান ছিল। বাঙালি জাতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশকে গড়তে সবাই ঐকবদ্ধভাবে কাজ করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী কিছু চক্র এদেশকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। একটি দেশের আর্থিক খাত যত শক্তিশালী হয় ওই দেশ তত দ্রুত উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। দেশের প্রয়োজনেই ওই সময় ব্যাংক-বীমা খাত রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এটা বঙ্গবন্ধুর গভীর প্রজ্ঞার ফসল। ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা সৃষ্টির তৎপরতা শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। বিশেষ করে পাট শিল্প, চিনি শিল্প, টেক্সটাইল খাত, আবাসন খাত, গার্মেন্ট খাত, পরিবহন ও সেবা খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যাপক বিনিয়োগের ফসলই হচ্ছে বড় বড় শিল্পপতি সৃষ্টি। দেশের যত বড় বড় গ্রুপ আজ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, এর সবই কিন্তু কোনো না কোনো ব্যাংকের সৃষ্ট। ব্যাংক-বীমা বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। কৃষিতে যে নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার পেছনে কিন্তু ব্যাংকের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। মৎস্য উৎপাদন খাতে বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বের ৪র্থতম দেশ। এর পেছনেও ব্যাংকের অবদান অনস্বীকার্য। ব্যাংক একদিকে যেমন সরাসরি উদ্যোক্তা তৈরি করেছে এর সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অপরদিকে ফরেন রেমিট্যান্স আহরণেও ব্যাংক সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বা সোস্যাল সেফটি নেট বাস্তবায়নে ব্যাংকারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আইটি খাত ও পরিবেশ রক্ষায় গ্রিন ফাইন্যান্সে ব্যাংক বিশেষ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জনে সরকারের সব পরিকল্পনার সঙ্গে ব্যাংকারদের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে যা অব্যাহত থাকবে আগামী দিনগুলোতেও।
প্রতিদিনের সংবাদ : ব্যাংকিং পেশায় আপনার রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের এখন কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম ফারুক : উদ্যোক্তা কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবেশ করবে এটা মূলত উদ্যোক্তার ইক্যুইটি জোগানের সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা, পণ্যের চাহিদা এবং বিশেষ করে ঝুঁকি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তবে আমাদের দেশে সেবা খাত, পর্যটন খাত, আইটি খাত এবং বিশেষ করে কৃষিজ কাঁচামাল নির্ভর শিল্প খাতে বিনিয়োগ করার অপার সুযোগ রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হবে আইটি খাত। ধীরে ধীরে এ খাত পোশাক শিল্পের বিকল্প খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
প্রতিদিনের সংবাদ : নতুন প্রজন্মের ব্যাংক সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
গোলাম ফারুক : সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংক। আমাদের দেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং সেবার বাইরের (টহনধহশবফ) এরিয়া বিবেচনা করলে ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আশার কথা এসবিএসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ০.৭০ শতাংশ। এসবিএসি ব্যাংক ওয়েভ বেইসড প্রোডাক্টের সব উপাদান নিয়ে আগামীতে হাজির হবে। আমাদের রয়েছে অনলাইন ব্যাংকিংসহ সব ডিজিটালাইজড সুবিধা। সেন্টাল প্রসেসিং ইউনিটের মাধ্যমে সব শাখায়ই ফরেন ট্রেড বিজনেস করা যায়। আনব্যাংকড এরিয়া ( টহনধহশবফ অৎবধ) অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে এসবিএসি ব্যাংকের দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। আমরা এগ্রো বেইসড প্রোডাক্ট ভিত্তিক শিল্পায়নে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। এসএমই, গ্রিন ব্যাংকিং, মহিলা উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা প্রদানে আমরা বিশেষ সুবিধা দেই। একটা কমপ্লায়েন্স ব্যাংক হিসেবে সমাজে পরিচিতি পেতে আমরা সচেষ্ট। এসবিএসি ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরা অত্যন্ত অভিজ্ঞ। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর ভালো ভালো ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের আরএমএ এবং ক্রেডিট লাইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের পদচারণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রতিদিনের সংবাদ : দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে- এর পেছনে কী কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
গোলাম ফারুক : দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ১ম ও ২য় প্রান্তিকে অনেকটা ধীরগতি ছিল এ কথা সত্য। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তৃতীয় প্রান্তিকে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। ২০১৭ সালে মূলধনী যন্ত্রপাতি খাতে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিদিনের সংবাদ : প্রযুক্তিগত ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আপনাদের ব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
গোলাম ফারুক : চলতি বছরে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। লেনদেন দ্রুত ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিষ্পন্ন এবং আমরা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছি। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শাখাগুলোতে বসেও গ্রাহকরা দেশের যেকোনো জায়গায় লেনদেন করতে পারছেন। এছাড়া আরটিজিএসের মাধ্যমে শুধু আমাদের ব্যাংক শাখাই নয়, গ্রাহকরা অন্যান্য ব্যাংক শাখার সঙ্গেও লেনদেন করতে পারছে। ব্যাংকে যত রকমের অনলাইন সেবা আছে, আমরা সব সেবাই গ্রাহকদের দেওয়ার চেষ্টা করছি। তিনি আরো জানান, এরই মধ্যে সারা দেশে বিশ্বমানের প্রযুক্তি নিয়ে ৬৪টি শাখার মাধ্যমে আমরা সেবা দিচ্ছি দেড় লাখের বেশি গ্রাহককে।
"