মযহারুল ইসলাম বাবলা

  ১৪ এপ্রিল, ২০১৭

বাংলা নববর্ষ : চেতনায় নেই রয়েছে ভোগে

মো গল সম্রাটদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার পরও লিখতে ও পড়তে তাকে আগ্রহী করা যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না জানা মোগল সম্রাট আকবর ছিলেন প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তার দীর্ঘ শাসনামলে মোগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। মুসলিম শাসক হলেও ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ-পদক্ষেপ তিনি কখনো নেননি। হিন্দু ও মুসলিম- প্রধান এই দুই সম্প্রদায়ের মিলিত সাহায্য-সহযোগিতায় দেশ শাসন করেছেন। উত্তর ভারতের অসীম সাহসী ও স্বাধীনচেতা রাজপুতদের সমর্থন লাভে এবং তাদের বশে আনতে রাজপুত নারী যোদাবাঈকে বিয়েও করেছিলেন। যোদাবাঈর ভ্রাতা মান সিংহ ছিলেন আকবরের সেনাপতি। মান সিংহ বঙ্গে এসেছিলেন ঈসা খাঁকে দমন করতে। এই ঢাকায়ই মান সিংহ প্রাণত্যাগ করেছিলেন। অসংখ্য ভাষাভাষী ভারতীয়দের ধর্মাচারে জাতীয়তাকে আকবর যথাযথ মর্যাদা প্রদান করেছিলেন বলেই তার শাসনামলে রাজ্যে রাজ্যে বিদ্রোহ তেমন দানা বাঁধেনি। রাজক্ষমতার সামাজিক ভিত্তি প্রসারে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তীর্থযাত্রীদের কর মওকুফ ঘোষণাসহ জিজিয়া কর পর্যন্ত বাতিল করেছিলেন। সব ভারতীয়কে একক ধর্মের অধীনস্থ করতেই ‘দীন-ই-ইলাহি’ (দিব্য বিশ্বাস) ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। এতে ধর্মীয় রক্ষণশীলরা সম্রাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। ধর্মদ্বেষী আখ্যায়িত করে তাকে সিংহাসনচ্যুত করতে নানা রকম চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ-সমাজপতিরা। আকবর দীন-ই-ইলাহির মাধ্যমে ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান ধর্মকে একীভূত করতে চেয়েছিলেন। আকবরের জোড়াতালির ধর্ম বিশ্বাস ভারতীয় সমাজপতিদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সম্রাটের বিরোধিতা না করলেও এই ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলে যেমন ধর্মীয় নেতারা, তেমনি অবস্থাপন্ন সমাজপতিরা। এ কারণে মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে নিগৃহীত ও নির্যাতন পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছিল।

অত্যন্ত বিচক্ষণতার অধিকারী আকবরের ছিল প্রখর বৈষয়িক বুদ্ধিও। রাজ্য দখল এবং ধন-সম্পদ লুটপাট সম্রাটদের শাসনামলের স্বাভাবিক বিষয় রূপেই গণ্য ছিল। রাজকোষাগার পূর্ণ করতে লুটপাটের পাশাপাশি সম্রাট আকবর ভূমির রাজস্ব আদায়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হতো। এর ব্যতিক্রমে কৃষকদের ওপর নেমে আসত নিষ্ঠুর খড়্গ। সব আবাদি জমিতে চাষাবাদে যেমন বাধ্য করা হয়েছিল, তেমনি অনাবাদি একখ- জমিও যেন অবশিষ্ট না থাকে, সেজন্য নিয়োজিত ছিল সম্রাটের নিয়োজিত রাজ কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সামন্ত মোড়ল। জমির জরিপে অতীতের দড়ি দিয়ে জমি মাপার পদ্ধতি বাতিল করে লম্বা বাঁশ দিয়ে জমি মাপার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। যেন জমির পরিমাপে হের-ফের না হয়।

সম্রাটের নিয়োজিত সামন্ত মোড়লদের ওপরই অর্পিত ছিল জমির প্রতিটি অংশের খাজনা ধার্য ও আদায়ের। আকবর নিজ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলোতে দ্রব্যসামগ্রীর পরিবর্তে অর্থমূল্যে খাজনা আদায়ের নির্দেশ জারি করায় কৃষকেরা মারাত্মক দুর্ভোগের মুখে পড়েছিল। মোড়লদের প্রত্যক্ষ তদারকিতে উৎপাদিত ফসল হাটে বিক্রি করে কৃষকরা খাজনা প্রদানে বাধ্য হয়েছিল। খাজনা প্রদানের পাশাপাশি কৃষকদের রাষ্ট্রীয় কাজে বিনা মজুরিতে শ্রম দিতে হতো। যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং দুর্গ ও রাস্তাসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকদের অংশ নিতে হতো। এর ব্যত্যয়ের উপায় ছিল না। ভারতবর্ষের কৃষি-অর্থনীতি গড়ে ওঠার পেছনে সম্রাট আকবরের নানা রকম উদ্যোগ অব্যাহত ছিল।

সম্রাট আকবরের শাসনামলে বঙ্গদেশ মোগলদের অধীনস্থ থাকায় কৃষিপ্রধান বঙ্গদেশের ঋতু-প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ফসল ওঠার মৌসুমকে উপলক্ষ করে অবাঙালি সম্রাট আকবর হিজরি সালের সঙ্গে সৌর হিসাব গণনায় বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন। শুরুতে নাম ‘আকবরি সাল’ থাকলেও পরবর্তীকালে তা ‘বঙ্গাব্দ’ রূপে বঙ্গদেশে প্রসার লাভ করেছিল। গ্রামীণ জীবন থেকে শুরু হলেও বঙ্গাব্দের বিস্তার ঘটে পুরো বঙ্গদেশে। অবাঙালি সম্রাট আকবর বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি গভীর প্রীতির কারণে কিন্তু সালটির প্রবর্তন করেননি। বরং খাজনা আদায়ের মোক্ষম সময় বিবেচনায় এর প্রবর্তন করেছিলেন। কৃষকদের থেকে বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু হলেও সব পেশার মানুষ বঙ্গাব্দ অনুসরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ইংরেজ শাসনের আবর্তে প্রচলিত বঙ্গাব্দ খ্রিস্টীয় সালের প্রভাবে কোণঠাসার কবলে পড়ে। ব্রিটিশ-ভারতে বঙ্গাব্দের ব্যবহার শঙ্কার মুখে পড়েছিল বটে, কিন্তু পরিত্যক্ত হয়নি। খ্রিস্টীয় সনের রাষ্ট্রীয় প্রভাবের পরও বঙ্গাব্দ সর্বত্রই বিরাজিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরই পূর্ব বাংলায় বঙ্গাব্দকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিত্যাগে রাষ্ট্র নানামুখী অপপ্রচারে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, বঙ্গদেশে হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, অর্থ-বিত্তে, জমি-জমিদারিতে- প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ছিল অগ্রসর। সেই তুলনায় মুসলিম সম্প্রদায় ছিল পশ্চাৎপদ। বাংলা সন-তারিখের ব্যবহার হিন্দু সম্প্রদায় অধিক হারে করত বলেই বঙ্গাব্দ তথা বাংলা সনের ওপর হিন্দুয়ানি মোড়ক সেঁটে দেওয়ার নানা রকম চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান বঙ্গাব্দের বিরোধিতা করেছিল বটে, কিন্তু তা হিজরি সনকে চাপানোর উদ্দেশ্যে নয়। বরং বঙ্গাব্দকে নির্মূল করতেই। পাকিস্তানি রাষ্ট্র প্রতিপক্ষরূপে হিন্দুদেরই বিবেচনা করত; অন্য ধর্মাবলম্বীদের নয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে তো বটেই। পাকিস্তান আমলে বাংলা সন-তারিখের ব্যবহার গ্রামীণ বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই ছিল; নগরকেন্দ্রিক মানুষের মধ্যে ততটা নয়। নববর্ষকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের উৎসব-পার্বণের তেমন নজিরও ছিল না। আমাদের জাতীয়তাবাদী উন্মেষে শহরকেন্দ্রিক বাংলা নববর্ষ পালনের প্রবণতা গড়ে ওঠে। তবে ব্যাপক আকারে নয়; সীমিত পরিসরে। অপরদিকে, হিন্দু সম্প্রদায় কিন্তু বাংলা নববর্ষ পালনের পাশাপাশি চৈত্র সংক্রান্তি মেলারও আয়োজন করত। সেই চৈত্র সংক্রান্তি মেলা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতো। ঢাকার লালবাগ শশ্মানঘাটের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে চৈত্র সংক্রান্তি মেলা দেখতে যেতাম। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় সেই মেলাকে ‘চৈত পূজার মেলা’ বলে অভিহিত করত। চৈত্রের শেষ দিনটিতে বৃষ্টি ছিল অনিবার্য। মেলা দেখা শেষে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরতাম। বাংলা নববর্ষের দিন হিন্দু সম্প্রদায় স্নান শেষে নতুন জামা-শাড়ি গায়ে চড়িয়ে অভুক্ত অবস্থায় আমের শাখা, ঘট ইত্যাদি নিয়ে ছুটত মন্দিরে, পূজা দিতে। মন্দির থেকে ফিরেই আহার করত। হিন্দু পরিবারগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। তবে মুসলিম পরিবারে এদিন উৎসব-পার্বণের বিন্দুমাত্র আমেজ ছিল না। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ব্রাহ্মণদিতে পূজা-অর্চনার মতো মুসলিম ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মৌলভী দিয়ে মিলাদের আয়োজন করত। কিন্তু গৃহে-পারিবারিক পরিমন্ডলে মুসলিম সম্প্রদায়ে দিনটি মোটেও পালিত হতো না। বাংলা নববর্ষকেন্দ্রিক উৎসবকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্যে দিবসটিকে অসাম্প্রদায়িক ভাবারও উপায় ছিল না। এক নববর্ষে কলকাতায় ছিলাম। সেখানকার বাংলা নববর্ষের উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা পথে-ঘাটে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। বিশেষ স্থানে নববর্ষকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান দেখেছি। বাঙালি মুসলমানদের কিন্তু বাংলা নববর্ষ নিয়ে মাতামাতি করতে দেখিনি। তাদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, দিনটিকে তারা হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব রূপেই বিবেচনা করে থাকে। দিনটিকে ঘিরে সব আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতায় ধর্মযোগ হওয়ায় কলকাতার বাঙালি মুসলমানরা বাংলা নববর্ষ পালনে মোটেও আগ্রহী হতে পারেনি। কলকাতা বাঙালিদের প্রদেশের রাজধানী হলেও কলকাতা শহরে বাঙালি কিন্তু সংখ্যালঘু এখন। মাড়োয়ারি, শিখ, পাঞ্জাবি, বিহারি, বিভিন্ন জাতির মানুষের সংখ্যা বিচারে কলকাতায় বাঙালিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত। এ কারণে কলকাতায় বাংলা নববর্ষ নিয়ে আমাদের দেশের মতো মাতামাতি দেখিনি। শহরতলিতে ও মফস্বলে রয়েছে, তবে ব্যাপক আয়োজনে নয়। আমাদের দেশের প্রতিটি শহরে বাংলা নববর্ষে উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা নজির সৃষ্টি করেছে। এত অধিক মাত্রায় অন্য কোনো উৎসব পালন হতে দেখা যায় না। তবে বঙ্গাব্দের সন-তারিখের ভিত্তিতে একমাত্র এই দিনটিকেই আমরা পালন করে থাকি। আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং সমাজজীবনে দ্বিতীয় অপর একটি দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা বাংলা সন-তারিখের ভিত্তিতে পালিত হয়ে থাকে।

গ্রামীণ জনপদের কৃষকদের খাজনা প্রদানের ওপর ভিত্তি করে যে বঙ্গাব্দের উৎপত্তি, কালক্রমে সেই কৃষকের জীবনাচারে বাংলা নববর্ষ পালনের দৃষ্টান্ত কিন্তু এখন নেই। কেবল শহুরে মানুষদের আনন্দ-বিনোদনের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের বাকিতে বেচা-বিক্রির হালখাতার প্রচলনও এখন তেমন নেই। মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই জাকাত প্রদানের সুবিধায় রমজান মাসে হালখাতা নবায়ন করে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে হালখাতার প্রচলন রয়েছে। তবে অধিকাংশ খ্রিস্টীয় নববর্ষের অনুসরণে এখন হালখাতা করে থাকে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের সমাজজীবনে বঙ্গাব্দের আবেদন তেমন নেই। বিস্মৃতপ্রায় বঙ্গাব্দ একটি দিনে জেগে ওঠে প্রবল বেগে। সেটা বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ পালনকে কেন্দ্র করে। রাজধানীসহ দেশের সব শহরে নববর্ষ অতি আড়ম্বরে পালিত হয়। নববর্ষ পালনে ভোগবাদিতার সীমা-পরিসীমা থাকে না। অথচ চেতনার স্থানটি শূন্য। আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা আজ বিশ্বায়ন নামক হুমকির কবলে, যা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অথচ এক দিনের নববর্ষ পালনে বাঙালিয়ানার নজির সৃষ্টি করলেও আশ্বস্ত হওয়ার কিন্তু উপায় নেই। উৎসবের আধিক্যে ভোগবাদিতা যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে তো সন্তুষ্টির কারণ নেই। অন্তঃসারশূন্য উৎসবের আধিক্যে জাতীয়তাবোধ আমাদের সমাজজীবনে ন্যূনতম প্রভাব ফেলেছে বলেও ভাবতে পারি না। সমষ্টিগত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন শহরের সুবিধাভোগী শ্রেণির এই ভোগবাদিতায় জাতীয়তার চেতনার স্থানটি ক্ষীণ। নববর্ষকেন্দ্রিক ভোগবাদিতার মূলে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ মুনাফার কারণেই নানা তৎপরতায় শামিল হয়। দেশজ সংস্কৃতি পরিত্যাগে যারা নিজেদেরকে সমষ্টির থেকে পৃথক করেছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে, তারাই তো পালন করে বছরের এই একটি দিনের বাংলা নববর্ষ। পুঁজিবাদ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার মূল লক্ষ্য মুনাফা। মুনাফার প্রয়োজনে সেসব ক্ষেত্রে হাত বাড়ায়। ভোগবাদিতা পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। নানা পসরার আয়োজনে পুঁজিবাদ জাল বিছিয়েছে। ওদিকে, নববর্ষকেন্দ্রিক নানা আয়োজন-উৎসব-আনুষ্ঠানিকতায় কর্পোরেট পুঁজির আধিক্যও লক্ষণীয়। এক দিনের বাঙালি হওয়ার অভিলাষই প্রমাণ করে, জাতীয়তার টানে নয়, একমাত্র উৎসবে গা ভাসানো ভোগবাদিতাই উপলক্ষ মাত্র। এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ দেড়-দুই হাজার টাকায় কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই; এবং থাকার কথাও নয়। সমাজের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের পক্ষেই তা সম্ভব এবং তারা তা সম্ভব করে তুলেছে। এক দিনের বাঙালি হওয়ার অমরত্বে নববর্ষে খাদ্য ও বস্ত্র বিলাস তারা সহজে মিটিয়ে থাকে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নববর্ষের উত্তাপ থেকে যোজন যোজন দূরে। এই উৎসব-আনন্দ তাদের স্পর্শ করতে পারে না অর্থনৈতিক কারণেই। এ কারণেই এই উৎসব সর্বজনীন হতে পারেনি।

নববর্ষ পালনের বিরোধিতা নিশ্চয়ই করছি না। আমাদের জাতীয় উৎসব-পার্বণের ক্ষেত্রে এই একটি মাত্র দিন, যা সব ধর্ম-বর্ণ মিলে পালিত হয়। একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসব। তবে এই উৎসব পালনকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের নানা রকম দৃষ্টান্তও কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ১৪ এপ্রিলের নির্দিষ্ট দিনে নববর্ষ পালন করে না। তারা লগ্ন, তিথি, লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসরণে দিনটি পালন করে থাকে। এই বিভক্তি আমাদের জন্য নিশ্চয়ই শুভ বার্তা বহন করে না। বঙ্গাব্দের নববর্ষে ধর্মযোগ প্রত্যাশিত নয়। নববর্ষের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটিকে সাম্প্রদায়িকতার নিরিখে পালন কাক্সিক্ষত হতে পারে না। বঙ্গাব্দ প্রবর্তন ধর্মীয় বিবেচনায় প্রবর্তিত হয়নি। এখানে ধর্মের বিন্দুমাত্র যোগসূত্রতার অবকাশ নেই। অথচ হিন্দু সম্প্রদায় দিনটিকে ধর্মীয় বিবেচনায় পালন করে দিনটির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ক্ষুণœ করেছে এবং করছেও। আমরা চাই, অসাম্প্রদায়িক এই উৎসব আমাদের জাতিসত্তার প্রতিটি মানুষের মিলিত উৎসবে পরিণত হোক। বাঙালি পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতায়-সহমর্মিতায় এক নতুন দিন সৃষ্টি করুক। বৈষম্যমূলক আচার-আচরণ নিরসন হবে। পারস্পরিক সৌহার্দ্যে আমরা সামষ্টিক বিবেচনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারব। এতে ভোগবাদিতার অবসান হবে, জাতীয়তার চেতনা শানিত হবে, সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সব মানুষের অংশগ্রহণে পালিত হবে বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক বাংলা নববর্ষ। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই অগ্রসর হওয়া অতি জরুরি। তবেই নববর্ষ পালন সার্থক হবে, সর্বজনীন হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist