মারুফ আহমেদ, কুমিল্লা

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিবিরবাজার স্থল শুল্ক স্টেশন

অবকাঠামো ও নজরদারির অভাবে বাণিজ্য বৈষম্য

দেশের সম্ভাবনায় স্থলবন্দর হওয়ার পরও কুমিল্লার বিবিরবাজারে এখানো গড়ে উঠেনি প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো। সেই সঙ্গে সীমান্তে সুষ্ঠু নজরদারির অভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে চোরাচালানি। ফলে বৈধভাবে বাণিজ্য করতে আগ্রহী হচ্ছে না দেশীয় ব্যবসায়ীরা। ভারতের সঙ্গে দিন দিন বাড়ছে বাণিজ্য বৈষম্য। বছর জুড়ে বাংলাদেশ থেকে ১০০ কোটি টাকার বেশি পণ্য ভারতে রফতানি হলেও আমদানি হচ্ছে মাত্র কয়েক লাখ টাকার পণ্য। তবে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন দুই দেশে বৈধ যাত্রী যাতায়াত করছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে এই তথ্য জানা যায়।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কুমিল্লা বিবিরবাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বিবিরবাজারস্থল শুল্ক স্টেশন’। ইতিহাস ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, দেশের অন্যতম প্রাচীন জনপদ কুমিল্লা এক সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। পাশাপাশি কুমিল্লার পূর্ব নাম ছিল ত্রিপুরা। বিগত শতাব্দির ১৯৫৮ সালে ত্রিপুরা বদলে করা হয় কুমিল্লা নাম। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই কুমিল্লার সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান সড়ক ছিল এটি।

সরেজমিনে স্থানীয় বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ভারতের সঙ্গে এ দেশের বিশাল বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় রুট হলেও ভৌত অবকাঠামোর অভাবে বাড়ছে না আমদানি-রফতানি। বন্দর থেকে কুমিল্লা নগর থেকে যাতায়াতের সরাসরি কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। অটোরিকশা, রিকশা কিংবা ইজিবাইকে চড়ে যেতে হয় বন্দরে। এ ছাড়াও বন্দর এলাকাসহ আশেপাশে নেই কোনো আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, ব্যাংক।

বন্দরের নিজস্ব অফিস কক্ষগুলোর অবস্থাও বেহাল। ছোট্ট একটি ভাঙাচোড়া টিনের ঘরে চলছে কার্যক্রম। পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য আসা ব্যবসায়ী বা যানবাহন চালক-সহকারী, দুই দেশে ভ্রমণকারীদের জন্য নেই এখানে কোনো যাত্রী ছাউনি, বিশ্রামাগার, টয়লেট, পানীয় খাবার বা জরুরি চিকিৎসা সুবিধা। ফলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতে হয় তাদের। কোনো কারণে ভ্রমণে অসুবিধা হলে ফিরে যেতে হয় আট কিলোমিটার দূরে নগরীতে।

সরেজমিন ঘুরে আরো দেখা যায়, বর্তমানে এ দেশ থেকে অনেকেই চিকিৎসা সেবা নিতে যাচ্ছে ভারতে। অসুস্থ বা সংকটাপন্ন রোগীদের বহনে নেই কোনো অ্যাম্বুলেন্স, হুইলচেয়ার বা জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা। বন্দরের সামনে সড়কের পাশে মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে বিশ্রাম বা অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় অসুস্থ রোগী, বয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশুদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্থল বন্দরটিতে ডাম্পিং সুবিধা কার্যকর না হওয়ায় এ দেশ থেকে রফতানিকৃত পণ্য বোঝাই গাড়িগুলো সরাসরি ভারতে প্রবেশ করে মালামাল খালাস করে ফিরে আসছে। এতে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিবিরবাজার স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ১২০ কোটি টাকার পণ্য ভারতে রফতানি হয়। যার মাঝে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সর্বাধিক ১৪ কোটি ৭৯ লাখ ২ হাজার ৯১০ টাকা পণ্য রফতানি হয়েছে। আর সবচেয়ে কম রফতানি হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে, পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ১৭ হাজার ৪০৬ টাকার পণ্য রফতানি হয়েছিল।

কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, রফতানি পণ্যের মাঝে প্রধান হচ্ছে সিমেন্ট। এ ছাড়াও অন্যান্য পণ্যগুলো হচ্ছে পাথর, নেট, প্লাস্টিক সামগ্রী, টাইলস্, ঢেউটিন, ইট ভাঙার মেশিন। এদিকে, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো মালামাল আসছে না বৈধভাবে। ভারত থেকে বৈধ পথে আসছে শুধু তেঁতুল, বেল, আদা। গত অর্থবছরে মাত্র ৬০ লাখ টাকার কিছু বেশি পণ্য এসেছে এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে।

বন্দরের দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিদিন সীমান্ত পথে অবাধে ভারত থেকে কোটি কোটি টাকার পণ্য চোরাই পথে প্রবেশ করায় বৈধ পথে আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায়। প্রতিদিন ভারত থেকে মাদকদ্রব্য ছাড়া চোরাই পথে জিরা, গরু মোটাতাজাকরণ, যৌন উত্তেজক, নেশা জাতীয় ট্যাবলেট, গরু, ছাগল, মহিষ, মুরগির বাচ্চা, থ্রি পিস, শাড়ি, থান কাপড়, সাইকেল, হোন্ডা, গুঁড়ো দুধ, কসমেটিকস্, বাঁশ, কাঠ, হরলিক্স, চামড়া, টায়ার, বিভিন্ন যানবাহনের পার্টস, চকলেটসহ কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আসছে। এ দেশ থেকে যাচ্ছে বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষধ, আলু, সাবান, মাছ, চিপস, কোমল পানীয়।

বন্দরে আসা আলম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকা এবং অবৈধভাবে মালামাল প্রবেশের সুযোগ থাকায় বৈধভাবে বাণিজ্যে আগ্রহী হচ্ছে না এখানকার ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, প্রতিদিনই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবাধে নানা পণ্য প্রবেশের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বৈধভাবে আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।

বন্দরে কর্মরত ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার সাধনজিৎ চাকমা বলেন, আমাদের এখানে ১২টি পদ থাকলেও বর্তমানে ছয়টি পদ শূন্য রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। এ ছাড়াও ইন্টারনেট সুবিধাও শূন্যের কোঠায়। তিনি স্বীকার করেন, এখানে ব্যাংকিং কার্যক্রম না থাকায় ভ্রমণকরসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অসুবিধা হচ্ছে ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close