হাসান জাবির

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

তুরস্ক ও ন্যাটো সম্পর্কে নতুন মাত্রা

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুরস্কের এই পরিবর্তন ন্যাটোর চেতনাকে মøান করে তোলা হয়। ফলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মস্কোও আঙ্কারার মনোভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া তুরস্কের কাছে নিজের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রির

ব্যাপারে সম্মতি দিলে ন্যাটো-তুরস্ক সম্পর্ক মারাত্মক সংকটে পড়ে

নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো জোটের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের মধ্যকার কৌশলগত মৈত্রীর সেতুবন্ধন হিসেবে চিহ্নিত হয় ন্যাটো। পরবর্তীতে এই সামরিক জোট দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ওই সময়গুলোতে ন্যাটোর ভিন্নধর্মী সামরিক ভূমিকা প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। বলা চলে, ন্যাটোর দাপুটে সামরিক ভূমিকায় বিশ্বব্যবস্থা অনেকটাই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। যদিও স্নায়ুযুদ্ধের টান টান উত্তেজনার মধ্যে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছর পরই তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে উঠে পাল্টা বহুজাতিক সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্ট। এ পর্যায়ে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বব্যবস্থায় পুনরায় শক্তির ভারসাম্য ফিরে আসে। অবশ্য এর আগে ন্যাটোর আকার-আকৃতিগত একটি তাৎপর্যময় সম্প্রসারণ ঘটে ১৯৫২ সালে। ওই সময় দুটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুরস্ক ও গ্রিস এই জোটে যোগ দিলে সামগ্রিক পরিস্থিতি পশ্চিমাদের অনুকূলে চলে যায়।

তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করার লক্ষ্যেই গঠিত হয়েছিল সামরিক জোট ন্যাটো। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরে অবস্থিত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশ নিজেদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে অভিন্ন কর্মকৌশল প্রণয়নের সুযোগ পায়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইউরোপ অভিমুখী সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। সমীকরণের এই অনিবার্যতা একই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা ভীতি প্রশমন করে। এ ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তুরস্কের ন্যাটো জোটে যোগদান ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর আগে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে পশ্চিমারা। ওই সূত্র ধরে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক রূপান্তর সংঘটিত হয়। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক ন্যাটোতে যোগ দিলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। একই সঙ্গে ন্যাটো জোটের শক্তি সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে কৃষ্ণসাগরীয় এলাকা থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত মস্কোর একচেটিয়া প্রভাব ঝুঁকির মুখে পড়ে। অন্যদিকে সোভিয়েত সমর্থিত আরব জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে খুব নীরবে তুরস্কের সাংঘর্ষিক সমীকরণের সূত্রপাত ঘটে। এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেই গত সাত দশক থেকে ন্যাটো ও তুরস্কের সম্পর্ক অবিচল থাকে। সর্বশেষ ২০১১ সালে সিরিয়া সংকট শুরুর প্রাক্কালে তুরস্কের মাটিতে নতুন করে সামরিক শক্তি সমাবেশ করে ন্যাটো। এ পর্যন্ত ন্যাটো-তুরস্ক সম্পর্কে সবকিছু ঠিক ছিল বলেই সবাই মনে করতেন। কিন্তু এর অল্প বিস্তর পর থেকেই ন্যাটো-তুরস্ক সম্পর্কের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে। এ ক্ষেত্রে তিন বছর আগে তুরস্কের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় আঙ্কারার বোধোদয় ঘটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিজের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সামরিক পরিকল্পনায় গুরুতর পরিবর্তন আনে। দেশটির পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতির দৃশ্যমান পরিবর্তনের সাম্প্রতিক এ প্রেক্ষাপটেই ন্যাটো-তুরস্ক বিবাদ প্রকট আকার ধারণ করে।

সর্বশেষ গত মাসে অনুষ্ঠেয় ন্যাটোর লন্ডন সম্মেলনের আগে ও পরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত নানামুখী গুঞ্জন লক্ষ করা যায়। মূলত ন্যাটোর বিশেষ সামরিক পরিকল্পনা-সংক্রান্ত বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ প্রকাশ্য হয়ে উঠে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক ন্যাটোর বাল্টিক তথা পূর্ব ইউরোপীয় পরিকল্পনায় সম্মতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। একই সঙ্গে ওই পরিকল্পনায় নিজ সমর্থন দেওয়ার শর্ত হিসেবে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ক্রিয়াশীল মার্কিন মিত্র কুর্দিদের সন্ত্রাসী হিসেবে ন্যাটোর স্বীকারোক্তি দাবি করে তুরস্ক। এ ধরনের বিবাদের জেরে দুই পক্ষের মধ্যে জোটগত সবার্থের বাইরে নিজ নিজ সবার্থ বড় হয়ে ওঠে। যে কারণে আমাদের ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপ পরিকল্পনা সম্পর্কে একটু দৃষ্টিপাত করা দরকার। ন্যাটোর ইউরোপ পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই আছে বাল্টিক অঞ্চল। এতদ উদ্দেশ্যে একসময়ের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের তিনটি বাল্টিক দেশ লাটভিয়া, লিথুনিয়া ও এস্তোনিয়াকে সুরক্ষার নামে পূর্ব ইউরোপে ব্যাপক ভিত্তিক সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করাই এখানে ন্যাটোর প্রধান লক্ষ্য। পাশাপাশি অন্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রুশ ভীতি ছড়িয়ে সেখানে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি কিংবা অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম স্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও রুমানিয়ায় ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করার প্রসঙ্গ। উল্লেখ্য, গত দশক থেকে সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে রুশ-ন্যাটো, রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতিশীল পরিস্থিতি এ মুহূর্তে তুরস্কের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় আসে সাম্প্রতিক সময়ে মস্কো-আঙ্কারা সম্পর্কের উষ্ণতা। মূলত বেশ কয়েক বছর থেকেই তুরস্ক নিজের আকাশ প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার অবসান করতে ন্যাটোর আওতায় আমেরিকার দ্বারস্থ হয়। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট ও পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ কেনার ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও এ দুই গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি সরঞ্জাম তুরস্ককে দিতে সময়ক্ষেপণ করে আমেরিকা। এরমধ্যেই তিন বছর আগের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় তুরস্কের নীতিনির্ধারকদের চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এ পর্যায়ে আঙ্কারা বিকল্প কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মস্কোর দ্বারস্থ হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তুরস্কের এই পরিবর্তন ন্যাটোর চেতনাকে মøান করে তুলে। ফলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মস্কোও আঙ্কারার মনোভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঢেলে সাজাতে সচেষ্ট হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া তুরস্কের কাছে নিজের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রির ব্যাপারে সম্মতি দিলে ন্যাটো-তুরস্ক সম্পর্ক মারাত্মক সংকটে পড়ে। এ নিয়ে ন্যাটো জোটের অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে এস-৪০০ চুক্তি থেকে সরে আসার জন্য আমেরিকা তুরস্কের ওপর নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু আঙ্কারা নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে। অন্যদিকে রাশিয়াও নিজের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত তুরস্কের কাছে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি-সংক্রান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এখানে একটু বলা দরকার যে, রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ অর্থাৎ সারফেস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি অপ্রতিরোধ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য এই অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির মাধ্যমে ৪০৪ কিলোমিটার দূরের যেকোনো আগ্রাসী ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র কিংবা যুদ্ধযানকে খুব নিখুঁতভাবে অ্যান্টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। রাশিয়ার তৈরি এ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেই সিরিয়ান সেনাবাহিনী বহিস্থ আগ্রাসন রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে ৩৬ কিংবা দরকার হলে ৭২টি আগ্রাসী ক্ষেপণাস্ত্রকে টার্গেট করতে সক্ষম এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সিরিয়ান সেনাবাহিনী ছাড়াও চীন ও ইরান ব্যবহার করছে। অন্যদিকে এ ব্যবস্থা পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছে তুরস্ক ও ভারত। অন্যদিকে পেতে মরিয়া গ্রিস, সৌদি আরব, মিসর। এস-৪০০ ব্যবস্থার উন্নত ভার্সন এস-৫০০ ব্যবস্থা নির্মাণসম্পন্ন করেছে রাশিয়া। দ্রততম সময়ের মধ্যে এ ব্যবস্থা রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এস-৫০০ ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশে হস্তান্তর কিংবা বিক্রি করা হবে না বলে জানিয়েছে মস্কো। ধারণা করা হয়, চলতি বছরের শুরুর দিকেই রাশিয়া সিরিয়ার রণাঙ্গনে এ ব্যবস্থার পরীক্ষা চালিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে যে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার মধ্য দিয়ে ন্যাটো তুরস্ক সম্পর্কের কৌশলগত কার্যকারিতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতীতে তুরস্কের জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিবর্তে ন্যাটোর ছত্রছায়ায় আঙ্কারার সামরিক পরিকল্পনা আবর্তন আপাতত অবসান হয়েছে। এর ফলে তুরস্কের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ঝুঁকি কমেছে দুভাবে। প্রথমত, রাশিয়া ও তার মিত্র দেশসমূহ বিশেষ ইরানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক হয়েছে। ভবিষ্যতে দুটি দেশ আরো কাছাকাছি চলে এলে আঞ্চলিক পরিসরে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। আর এ প্রক্রিয়ায় ন্যাটোর প্রয়োজন আপাতত ফুরিয়েছে তুরস্কের। অন্যদিকে নিজ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে ন্যাটো অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তুরস্কের অপেক্ষাকৃত কম। এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটো তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আর গোপন কোনো বিষয় নয়। তবে এর চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close