ইসমাইল মাহমুদ

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

রক্ষা করতে হবে দেশীয় ফল

জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাড়িঘর নির্মাণ, নির্বিচারে ফলের গাছ কর্তন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী দেশি ফল হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে অর্ধশতাধিক দেশী ফল। অবস্থা দৃশ্যে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আগামী দুই যুগের মধ্যে দেশীয় ফল হারিয়ে যাবে আমাদের জীবন থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি বিভাগের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের চরম ব্যর্থতার কারণে দেশীয় ফল বিলুপ্তির হুমকিতে পড়ার একমাত্র কারণ। মাত্র দুই যুগ আগেও দেশের সর্বত্র দেশীয় ফলের রমরমা উৎপাদন লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে সে স্থান দখল করে নিয়েছে আমদানি করা বিদেশি ফল। এখন শতকরা মাত্র ২০ ভাগ দেশি ফলের বিপরীতে আমদানি করা বিদেশি ফল বাজার দখলে রেখেছে ৮০ ভাগ। কেমিক্যাল মেশানো আমদানিকৃত বিদেশি ফল দেশের মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। পাশাপাশি বাড়ছে পুষ্টি ঘাটতিও। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বেশি বেশি দেশি ফলের বৃক্ষ রোপণে গুরুত্বারোপ করেছেন ফল বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রকৃতি দেশীয় ফল উৎপাদনে অত্যন্ত সহায়ক। আমাদের গ্রামগঞ্জে রোপণ না করা সত্ত্বে অসংখ্য দেশি ফলের গাছ প্রকৃতিগতভাবে জন্ম নেয়। দেশি ফলের মধ্যে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত চার মাসে ৫৪ শতাংশ এবং ভাদ্র থেকে চৈত্র এ আট মাসে ৪৬ শতাংশ দেশি ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান ও উর্বর মাটির দেশ। এ দেশে দেশি ফল উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকলে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী দেশি ফল। ফল বিজ্ঞানীদের জরিপ অনুযায়ী, মাত্র দুই যুগ আগে এ দেশে প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে শতাধিক জাতের দেশি ফল পাওয়া যেত। আর দুই যুগ পরে বর্তমানে এর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে অর্ধশতে। তবে এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। তাদের মতে, বর্তমানে প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে কমপক্ষে ৬৫ জাতের দেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে যেসব দেশি ফল পাওয়া যাচ্ছে; সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, বেল, কদবেল, তেঁতুল, লটকন, পেয়ারা, আমড়া, কামরাঙা, জলপাই, কুল, গোলাপ জাম, আতাফল, শরিফা, সফেদা, চালতা, সাতকরা, কমলা, আনারস, লেবু, জামির, জাম্বুরা, বিলেম্বু, গাব, কাজুবাদাম, তুৎফল, চাম্পা কলা, আনাজি (কাচ) কলা, জামরুল, আমরুজ, বেতফল, লটকন, কদম, নারিকেল, তৈকর, আমলকী, ডালিম, সুপারি, বাঙ্গি, তরমুজ, বকুল, ডেউয়া, পেঁপে, তাল, পানিফল, খেজুর, আনার, অরবরই, লুকলুকি, চুকুর, প্যাসনফল, আঁশফল, মাখনা, পিচফল, ফসলা, কাউফল, করমচা, পানিয়ালা, আদা, জামির, বৈচি, মুনিয়া, ডেফল, চাম্বুল। এসব দেশি ফলের মধ্যে বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে করমচা, গাব, আঁশফল, আতাফল, ডুমুর, চালতা, কাউফল, ডেউয়া, চাম্বুল, অরবরই, বিলম্বি, সাতকরা, শরিফা, তৈকর, ডেফল, বৈচি, লুকলুকি ও মুনিয়া। যে অবস্থা চলমান তাতে আগামী এক যুগ পরে এসব দেশি ফলের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয় না।

বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ও অন্যান্য শতাধিক প্রজাতির দেশি ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউড়া গ্রামের আবদুল আলীম লোদী। তার নিজ বাড়ির আঙিনায় ‘লোদী গার্ডেন-১’ নামে গড়ে তোলা বাগানে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ও বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফলের বৃক্ষ স্থান পেয়েছে। তিনি তার বাগান থেকে দেশি ফলের চারা উৎপাদন করে বিনামূল্যে তা বিতরণ করে চলেছেন। এরই মধ্যে ২০১১ সালে তিনি বিয়ানীবাজারে ও ২০১২ সালে শ্রীমঙ্গলে করেছেন দেশি ফল উৎসব। তার অভিমত, দেশি অনেক ফল আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শহুরে অনেক তরুণ-যুবক অনেক ফলের সঙ্গে পরিচিত নন। তাদের দেশি ফলের সঙ্গে পরিচিত করে তোলা এবং এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে দেশি ফলের বৃক্ষ রোপণে উদ্বুব্ধকরণের লক্ষ্যে তিনি বৃক্ষ পরিচিতি ও ফল উৎসব করে থাকেন। তার মতে, দেশের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলাকা বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে এখন মোট আয়তনের মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ বৃক্ষ রয়েছে; যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য এক অশনিসংকেত। এ দেশের মানুষ গাছ কাটতেই বেশি আনন্দ পান। কিন্তু গাছ রোপণে আনন্দ পান এমন মানুষের সংখ্যা কমছে। কেউ না কেউ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে না এলে একসময় দেশ বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে। বৃক্ষ রোপণের সময় বেশি বেশি করে দেশি ফলের বৃক্ষ রোপণ করা আবশ্যক। এতে সবুজায়ন হবে দেশ এবং দেশের মানুষের ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা মিটবে। সেই সঙ্গে নিরসন হবে অর্থনৈতিক সংকটও। সফল হবে সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’। তিনি দেশের সর্বত্র ফলের বাগান গড়ে তুলতে প্রয়োজনে সরকার ও দেশের সাধারণ মানুষকে বিনা শর্তে সহায়তার হাত প্রসারিত করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান।

দেশের বিশিষ্ট ফল বিজ্ঞানী, ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম জানান, গত দুই দশকের মধ্যে দেশি ফলের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিলুপ্তির পথে। কাগজপত্রে বর্তমানে ৫৫ দেশীয় ফল চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে দেশীয় ফলের অস্তিত্ব রয়েছে মাত্র ৩৯টি। এ থেকে উত্তরণ ঘটানো আবশ্যক। নতুবা একসময় দেশীয় সব ফল আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে। তিনি জানান, দেশীয় ফল উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের বাজার দখল করে নিয়েছে আপেল, আঙ্গুর, বেদানা, স্ট্রবেরি, নাশপাতি প্রভৃতি আমদানি করা বিদেশি ফল। আমদানি করা ফলে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত বলে এসব ফল খেয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণে তিনি বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশীয় ফলের উৎপাদন ও সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগকে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার পক্ষে মত প্রদান করেন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close