মোবারক হোসেন

  ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

অর্থনীতি

সাগর গভীরে নতুন দিগন্ত

বিশাল জলরাশির সাগর। আছড়ে পড়া বড় বড় ঢেউয়ের অগণিত সারি, দূরে গিয়ে ছুঁয়ে যায় নীলদিগন্ত। এভাবে দেশ পেরিয়ে মহাদেশ, এমনকি বিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত, অন্তহীন জলরাশি। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলÑএ নিয়ে আমাদের এই পৃথিবী।

সাগরের গভীরে জাগতিক ভিন্নতা। রয়েছে নানা প্রকৃতির নানা রঙের মাছ। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়; রয়েছে ভয়াল প্রকৃতির জলজ প্রাণী। শৈবাল-প্রবালে আচ্ছাদিত সাগরের তলদেশ। সমুদ্রের গভীরে উৎসুক মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে গবেষণা; দখলে নিয়েছে নানা তত্ত্ব-উপাত্ত্য। সাগরের অনেক কিছুই এখন গবেষকদের নখদর্পণে।

আগে মানুষ নৌকা কিংবা মাছধরা ট্রলারে, দিনের পর দিন বিশাল জলরাশি পাড়ি দিয়ে, গভীর সাগরে যেত মাছ শিকারে। এখনো সে ধারা অব্যাহত। তবে অনেকে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক ফিসিংবোট ব্যবহার করে। আর এ মাছ ধরাই ছিল সাগর থেকে উপার্জনের প্রধান উৎস। কিন্তু এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। তৈরি হয়েছে সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি; যাকে বলা হয় ‘ব্লু-ইকোনমি’।

শুধুু মাছ ধরা নয়, সমুদ্র থেকে আহরিত তেল ও গ্যাসের অর্থব্যবস্থাপনাকে ব্লু-ইকোনমি বলা হলেও এর ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত্ব। বঙ্গোপসাগরে পর্যাপ্ত তেল-গ্যাস ছাড়াও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। লবণ, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ বা ব্লু-এনার্জি, খনিজ বালি, সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন, কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করে কৃষি সম্প্রসারণÑএখন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে।

শুধু তাই নয়, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈব্যপ্রযুক্তি, জাহাজ নির্মাণশিল্প, আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন, উপকূলীয় নৌপরিবহন এবং সমুদ্রনির্ভর ওষুধশিল্পও গড়তে পারে বাংলাদেশ। এসব উৎস থেকে আয় সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার। দেশ দুটো বর্তমানে সমুদ্র থেকে তেল ও গ্যাস আহরণ করছে। সমুদ্রসীমান্ত লাগুয়া এ দুটি দেশের তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র থাকায়, দেশের সম্পদ শোষিত হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। অথচ আমরা এ সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারছি না।

সংবাদ ভাষ্য মতে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ৫০ বছর থেকে সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা গবেষণা তো দূরের কথা, নীতিমালা পর্যন্ত করতে পারিনি। এ ব্যর্থতার দায় কার? সেটাই বড় প্রশ্ন। যদিও বলতে হবে, আমাদের সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে। কিন্তু দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ আছে কি নাÑএটাও দেখার বিষয়?

তবে এ অর্জনের মধ্যে একটা বড় প্রাপ্তিÑআন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে, ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এটাই জাতির কাছে ‘সমুদ্র বিজয়’ নামে পরিচিত। এ নিয়ে আমরা জাতীয় পর্যায়ে আনন্দ-উৎসবও করেছি। দেশের বর্তমান সমুদ্রসীমা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। ওই রায়ে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সব প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা সমুদ্র অর্থনীতির কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি।

এশিয়ার আরেক দেশ ইন্দোনেশিয়া। এ দেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে। এ দেশ ব্লু-ইকোনমিভিত্তিক যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদ জাতীয় আয়ের ১০ গুনে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা। আর অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র থেকে আয় করে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা ২০২৫ সালে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। চীন ও কোরিয়ার অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে ব্লু-ইকোনমি।

শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকা- হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। আরো তথ্য হচ্ছে, বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশের প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণী; ৩০ শতাংশ জ্বালানি তেল আসছে সাগর থেকে। তাই ব্লু-ইকোনমি নিয়ে ভাবনার চূড়ান্ত সময় এখন।

ব্লু-ইকোনমির ফলোপ্রসূ করতে হলে সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনা, আহরণের প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনশক্তি জরুরি। তার আগে প্রয়োজন নীতিমালা বা আইন; যে আইনের মাধ্যমে দেশের ব্লু-ইকোনমিক ব্যবস্থা পরিচালিত হবে। দেশে ব্লু-ইকোনমি বিষয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এর মধ্যে আইনি কাঠামো না-থাকা, প্রয়োজনীয় গবেষণার সীমাবদ্ধ, সক্ষমতা তৈরিতে কার্যকর উদ্যোগ না থাকা ও মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী মনে করা হচ্ছে।

দেশে নবগঠিত ব্লু-ইকোনমি সেল কার্যক্রম শুরু করেছে। ১৭টি মন্ত্রণালয় ও ১২টি বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে এ সেল। এর মাধ্যমে আইনের খসড়া তৈরির কাজ চলছে। খসড়া তৈরির পর যাবে আইন মন্ত্রণালয়ে; কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, এটা নিরীক্ষণ শেষে যাবে মন্ত্রিসভায়। ওই সভায় অনুমোদিত হলে সংসদে পাস হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কী ধরনের সময় প্রয়োজনÑতা কেউ বলতে পারছে না। সত্যি অবিশ্বাস্য! ব্লু-ইকোনমির ফল পেতে নাকি লেগে যেতে পারে পাঁচ থেকে ১০ বছরÑএমন আশঙ্কার সংবাদ ‘বাংলাদেশের খবর’-এ ছাপা হয়েছে।

এ সরকারের শাসনকালে উন্নয়নের পরিধি আরো বিস্তৃত্ব হয়েছে, সমুদ্রসীমাও বর্ধিত হয়েছে। তাহলে এর ফল পেতে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় হবে কেন? এমন জিজ্ঞাসা অনেকের। আমরা কি পারি না উন্নয়নের স্বার্থে আইন প্রণয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে? তাহলে এ সম্ভাবনাকে দ্রুত কাজে লাগানো যেত?

ভাবতে হবে, বিশ্বের দেশগুলোর সুগঠিত সামুদ্রিক অর্থনীতির কথা; যারা আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে, হতে পারে আদর্শও। তাদের অনুুকরণযোগ্য পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। প্রয়োজনে সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে ওই সব দেশের দক্ষ জনবল। সংগ্রহ করা যেতে পারে সহায়ক প্রযুক্তি। এ জন্য সর্বাগ্রে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা পেতে পারি ব্লু-ইকোনমির কাক্সিক্ষত সাফল্য।

আমরা মনে করি, জাতীয় স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে এবং ব্লু-ইকোনমির অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাবে। তাহলেই আমাদের অর্থনীতিতে খুলে যেতে পারে আরেকটি টেকসই উন্নয়নের দোয়ার।

লেখক : সাংবাদিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist